Opinion Politics

মৌলবাদের ১৩ দফা

আজমাইন শাহরিয়ার অর্ণব, যুক্তরাজ্য

২০১৩ সালের ৫ মে ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে মৌলবাদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে একটা ঐতিহাসিক সরকারী অভিযান। সেদিন মধ্যযুগীয় দাবী নিয়ে মতিঝিলে সমবেত মোল্লারা সরকার পতনের একটা চেষ্টা করছিল। এরকম পরিস্থিতি যে কোন দেশের সরকার যা করত সেদিন আওয়ামী লীগ সরকার সেটাই করছিল। মোল্লার দল সৌদি আরবে এরকম কোন সমাবেশ করলে তাদের স্রেফ ব্রাশ ফায়ার করে সবাইকে মেরে ফেলত। একশো ভাগ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ইউরোপে যাদের সম্মান জানানো হয় সেসব দেশে এই রকম বর্বর দাবী নিয়ে রাস্তা আটকে সরকার পতনের অবস্থানকে পুলিশ দিয়ে চরমভাবে দমন করা হতো। সেদিন মতিঝিলে যদি কোন হতাহতের ঘটনা ঘটে থাকে, ধরে নিলাম ঘটেছিল তার সম্পূর্ণ দায় হেফাজত ইসলামের। আওয়ামী লীগ সরকারের নয়।

জিয়াউর রহমান ৭ নভেম্বরের পর যেভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কোর্ট মার্শালের নামে হত্যা করেছেন সে তুলনায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক কারণে এত হত্যাকান্ড ঘটেনি। মতিঝিলে সেদিন মৌলবাদীদের সরাতে গিয়ে একজনও মারা গিয়ে থাকলে সেটি মৃত্যুই। কতজন গেছে সেটি বড় নয়। কিন্তু তার দায় হেফাজত ইসলামের। সরকার সেটাই করেছে যেটা সব সরকার করতো। বিশেষ কিছু বলার আগে হেফাজত ইসলামের ১৩ দফার দফাগুলো আবার সবাইকে জানানো দরকার। অন্তত ২০১৩ সালে যাদের বয়স ছিল ৮ বছর, ১০ বছর তারা যখন আমাদের মতিঝিলের ‘গণহত্যার’ গল্প বলতে আসে আর প্রশ্ন করে গত ১৫ বছর আপনারা কই ছিলেন তাদের জন্য বিশেষ করে তুলে দিচ্ছি-

হেফাজতের ১৩ দফা:

১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।

২. আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।

৩. কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা

৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।

৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।

৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।

৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।

৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।

৯. রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।

১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।

১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।

১২. সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।

১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।

এই দাবীগুলো না মানলে তারা সেদিন সরকারের পতন ঘটিয়ে ফেলবে। দাবী পূরণ করেই ঘরে ফিরবেন। কি কি দাবী? ১ নম্বরে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন বাতিল করে শরীয়া আইন জারি করতে হবে। ২ নম্বরে ব্লাসফেমি আইন পাশ করতে হবে। এই দুইটি দফা পূরণ মানেই বাংলাদেশ পাকিস্তানের মত আধা শরীয়া শাসিত দেশ হয়ে যাবে এবং রাষ্ট্রে মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে মুক্তমতকে আইনত নিষিদ্ধ করা হবে। ৩ নম্বরে শাহবাগে রাজাকারদের বিচারের দাবীতে গণআন্দোলনকারীদের বিচার করতে হবে। রাজাকার আল বদরদের বিচার চাওয়া যাবে না। রাজাকার আল বদরদের বিচার চাওয়া কি ইসলামের বিরুদ্ধে বলা? এখানে রসূল এলো কোথায়? ‘ক-তে কাদের মোল্লা তুই রাজাকার তুই রাজাকার’ বললে ইসলাম কিভাবে বিপন্ন হয়ে যায়?

এবার ৪ নম্বরটায় আসেন। “ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা” এই দাবী করতে আসা লোকজন আপনার ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে? আপনার গণতান্ত্রিক অধিকারে বিশ্বাস করে? নারীদের চাকরি লেখাপড়া স্বাধীন জীবন ও রাষ্ট্রীয় সমান অধিকারে বিশ্বাস করে? সেদিন হেফাজত ইসলামকে সমর্থনকারী ফরহাদ মজহার ও ফরিদা আখতার এই ১৩ দফাকেই সমর্থন করেছিল। ‘অধিকার’ এনজিও’র আদিলুর রহমানের ‘গণহত্যার’ দাবী ছিল মোল্লাতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান। “আমি কোন পক্ষে নই, আমি অন্যায় দেখলেই তার প্রতিবাদ করি”- এসব বলা লোকজনগুলো ইরানে আফগানিস্থানে মোল্লার শাসন ত্বরান্বিত করেছিল। সেদিন হেফাজতকে পিটিয়ে জায়গা খালি করার মধ্যে কোন অপরাধ নেই। আপনি মেয়েদের স্বাভাবিক জীবন যাপনকে “বেয়াল্লাপণা” বলবেন, আইন করে বন্ধ করার দাবী করবেন আর আপনাকে মানবাধিকার দিয়ে এসব প্রকাশ্যে বলতে দিবো? এর নাম কি বাক স্বাধীনতা? পৃথিবীর কোথাও এরকম ঘৃণামূলক বক্তব্যকে বাক স্বাধীন বলে? কাউকে হত্যা করতে চাওয়াকে বাক স্বাধীনতা বলবেন? কারোর ধর্ম পালনের অধিকার আইন করে নিষিদ্ধ করাকে বলবেন তার বাক স্বাধীনতা? হেফাজতের ৬ নম্বর দফা ছিল কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা করা। ৭ নম্বরে ছিল ভাস্কর্য মূর্তি ভেঙে ফেলার দাবী। এদেরকে কোন সভ্য সমাজে কি করা উচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নতুন করে ভাবা দরকার। যতদিন না ভেবে পাবেন ততদিন ২০১৩ সালের মত ব্যবস্থা নিতে হবে।

২০১৩ সালের মতিঝিলে ছিল বাংলাদেশের কোন সরকারের প্রথম মৌলবাদী জঙ্গি হেডকোয়ার্টার কওমিদের বিরুদ্ধে সত্যিকারের ব্যবস্থা। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারপরই কার পরামর্শে আওয়ামী লীগ হেফাজত ইসলামকে তোষণে উঠেপড়ে লেগেছিল। হেফাজত সরকার উত্খাত করে ফেলতে পারে- এই ভূত কি করে লীগের মাথায় ঢুকেছিল সেটি লীগের থিংকট্যাঙ্ক কি আজো ভেবে দেখেছে? দলের কারা ছিল হেফাজতের সঙ্গে সংযোগ তৈরি করতে? কারা এই বাস্তবতা দেখিয়েছিল হেফাজত ইসলাম বা কওমি মাদ্রাসাকে তোয়াজ না করে সরকার রক্ষা করা যাবে না? লীগের সেই মৌলবাদের প্রতি সফটনেস কাদের তা চিহ্নিত না করে লীগের কোন সংস্কার সম্ভব নয়। সেদিন ৫ মে পর বাংলাদেশের মৌলবাদের কাছা খুলে গিয়েছিল। সেদিন আওয়ামী লীগ সরকার তাদের কঠোরতা ও আপোষহীনতা ধরে রাখলে এই ১২ বছর পর বাংলাদেশে মৌলবাদের শক্তি নির্মূল হয়ে যেতো। ৫ তারিখ মোল্লাদের কান ধরিয়ে এরপর গত ১২ বছর নিজেরাই লীগ বারবার স্বেচ্ছায় কান ধরেছে এই লিল্লাখোরদের কাছে!

আমার কাছে ২০১৩ সালের ৫ মে হচ্ছে ঐতিহাসিক দিন। বাংলাদেশের মৌলবাদের বিরুদ্ধে সেক্যুলারিজম শক্তির অনুপ্রেরণার দিন। সোজা কথা বাংলাদেশে দুটো শক্তি- মৌলবাদ আর সেক্যুলাজিম। যুদ্ধ সংঘাত অনির্বায!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *