বীপেন রাজবংশী, যুক্তরাজ্য
আল্লাহ’র ব্যাপারে যদি কেউ মুসলমানদের সাথে ভিন্ন মত পোষণ করে তবে সে একজন অপরাধী এবং এই অপরাধের একমাত্র শাস্তি হল মৃত্যুদণ্ড। এবং এই শাস্তি মউকুফের একমাত্র পন্থা হল জিজিয়া। অর্থাৎ একজন ভিন্ন মতের লোককে যদি মুসলিম রাষ্ট্রে প্রাণে বেঁচে থাকতে হয় তবে তাকে সরকার নির্ধারিত পরিমাণ সম্পদ জিজিয়া কর হিসাবে প্রদান করতে হবে। তবে সে যদি নিয়মিত জিজিয়া প্রদান করে তবে তার প্রাণ এবং সম্পদ “অন্য মুসলিমদের হাত থেকে” রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের।
মুহাম্মদ খাইবারের অমুসলিমদের ওপরে বিজয়ী হবার পর তাদের সেই অঞ্চল থেকে বিতাড়িত করতে চায়। কিন্তু খাইবারের অমুসলিমরা যখন তাদের বাৎসরিক উৎপাদনের অর্ধেক ফল মুহাম্মদকে জিজিয়া হিসাবে প্রদান করার প্রস্তাব দেয় এবং বিনিময়ে খাইবারে অবস্থান করার অনুমতি চায় তখন মুহাম্মদ তাদের সে প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং এই শর্তে তাদের যতদিন ইচ্ছা খাইবারে বসবাস করার অনুমতি দেয়।
জিজিয়া নেয়ার কারণ হিসাবে আরও একটা কারণ বলা হয় (জিজিয়ার পক্ষে সাফাই গাইতে অটোম্যান খলীফারা সব থেকে বেশি এই যুক্তি প্রচার করতো)। যেহেতু ইসলামী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অমুসলিমদের কোন ভূমিকা নেই, সেহেতু তাদের থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করা হয় এবং এই অতিরিক্ত অর্থ মুসলিম রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার কাজে নিয়োজিত যে মুলসিম সৈন্যরা আছে তাদের ভরণপোষণে ব্যয় করা হয়। কিন্তু তাদের এই যুক্তি খুবই দুর্বল এই জন্য যে, মুলসিমরাই অমুসলিমদের সেনাবাহিনীতে সুযোগ দেয় না, এটা শরিয়ার বিধান, কোন অমুসলিম, একটি মুসলিম দেশের সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে পারবে না। এক ধরনের অবিশ্বাস থেকেই এই আইনটি তৈরি করা।
বস্তুত সকল জিজিয়াই জোরপূর্বক তবে এদের মধ্যে একটা সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে । মুসলিমরা যখন অমুসলিমদের এলাকা দখল করে নিবে তখন তারা অমুসলিমদের উপর জিজিয়া আরোপ করবে। যদি অমুসলিমরা এই শর্তে রাজি হয় তবে মুসলিমরা তাদের হত্যা করবে না । এই শর্তে যে জিজিয়া নেওয়া হয় সেটা “জিজিয়া সুলহিয়া।” এই ব্যাপারে সব মাজহাবের অনুসারীরাই একমত । তবে কেউ এই শর্ত ভঙ্গ করলে কি হবে সেটা নিয়ে দ্বিমত আছে । হানাফি এবং মালিকি মাজহাবের অনুসারীরা মনে করে যারা জিজিয়ার শর্ত ভঙ্গ করবে তাদের আক্রমণ করে তাদের থেকে জোরপূর্বক জিজিয়া আদায় করে নিতে হবে,তারা যদি জিজিয়ার শর্ত পূরণে অপারগ হয় তবে তাদের স্ত্রী কন্যাদের দাসী হিসাবে ভোগ/বিক্রি করা যাবে এবং কর্মক্ষম পুরুষদের দাস হিসাবে ব্যাবহার বা বিক্রি করা যাবে। এভাবে করের সমপরিমাণ ক্ষতিপূরণ আদায় হয়ে গেলে ওই বছরের মত তাদের উপর আর কোনরূপ জবরদস্তি করা যাবে না। এইভাবে আদায়কৃত জিজিয়াকে বলে জিজিয়া আনাইয়া বা জবরদস্তি মূলক জিজিয়া । অপরপক্ষে , শাফি এবং হানবলি মাজহাব এর অনুসারীরা মনে করে জিজিয়া আনাইয়া আদায় না করে প্রচলিত কিতালের বিধান অনুসারে তাদের বিরুদ্ধে জুদ্ধ করে তাদের বালেগ পুরুষদের হত্যা করতে হবে এবং তাদের স্ত্রী কন্যা এবং অর্জিত সকল সম্পদ গনিমতের মাল হিসাবে ভোগ করা হবে । মুহম্মদের সাহাবিদের মধ্যে খুব প্রসিদ্ধ একজন সাহাবি ছিলেন আমর-ইবন-আল-আস । উনি বারকা (বর্তমান লিবিয়ার উত্তর পূর্ব একটি অঞ্চল ) এর লোকদের উপরে জিজিয়ার যে পরিমাণ নির্ধারণ করেছিলেন সেটা প্রদানে তারা ব্যার্থ হলে তিনি তাদের স্ত্রী কন্যাদের দাসী হিসাবে বিক্রি করে জিজিয়ার সমপরিমাণ অর্থ প্রদানে বাধ্য করেন । জিজিয়ার শর্ত পূরণ করে(উপার্জনক্ষম বালেগ) এমন একজন ব্যাক্তি যদি জিজিয়া প্রদানে অস্বীকৃতি জানায় (কিন্তু তার গোত্রের সবাই নিয়মিত জিজিয়া দিয়ে থাকে ) তবে ওই ব্যাক্তির ক্ষেত্রে ইসলামের বিধান হচ্ছে তাকে হত্যা করতে হবে অথবা তার স্ত্রী কন্যাদের দাসী হিসাবে ব্যাবহার করতে হবে এবং পরিবারের বাকি পুরুষদের দাস হিসাবে বিক্রি করতে হবে।
জিজিয়া কিভাবে আদায় করতে হবে সে ব্যাপারে তাফসীর সমূহেই বেশ বিস্তারিত লেখা আছে। আমি আরও কিছু ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত ইসলামী স্কলারের উক্তি তুলে ধরলামঃ
বিখ্যাত ইসলামী বিশ্লেষক আল-জামাকশারী জিজিয়া প্রদানের ব্যাখ্যা দিয়েছেনঃ
তাদের নিকট থেকে জিজিয়া নেয়া হবে অবমাননা ও মর্যাদাহানিকরভাবে। জিম্মিকে সশরীরে হেঁটে আসতে হবে, ঘোড়ায় চড়ে নয়। যখন সে জিজিয়া প্রদান করবে, তখন কর-আদায়কারী বসে থাকবে আর সে থাকবে দাঁড়িয়ে। আদায়কারী তার ঘাড় ধরে ঝাঁকি দিয়ে বলবে, ‘জিজিয়া পরিশোধ কর।’ এবং জিজিয়া পরিশোধের পর আদায়কারী ঘাড়ের পিছনে একটা চাটি মেরে তাকে তাড়িয়ে দিবে।
জিজিয়ার হাত হতে মুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল কলেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করা। এবং জিজিয়া পরিশোধ করতে ব্যর্থ হলে শাস্তি হলো এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়া কিংবা মৃত্যুদণ্ড।