Atheism in Bangladesh LGBTQ+

ট্রান্সজেন্ডারশিপ ধর্মবিরোধী হলে যৌন চিকিৎসা ও সার্জারি কি শরীয়তসম্মত ?

মোহাম্মদ ফয়েজ হোসেন, যুক্তরাজ্য

আমরা কেন যেন অনেক ইস্যুতেই অজ্ঞ, অর্ধশিক্ষিত ও জ্ঞানপাপীদের অপপ্রচারের কাছে পরাস্ত হই! এক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের অনেকেই সেইসব ইস্যুতে বিভ্রান্ত হয়ে চিলে কান নেওয়া গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়। সাম্প্রতিক ট্রান্সজেন্ডার ইস্যু তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আশির দশকে সিরিয়ার প্রখ্যাত সুন্নি আলেম শায়খ আলী তানতাবী ও ইরানের শীর্ষ শিয়া আলেম খোমেনি লিঙ্গ পরিবর্তন ইসলামে অনুমোদিত বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পথে বাংলাদেশে জেন্ডার আইডেন্টিটি ও সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশনকে গুলিয়ে ফেলে আলেম বা শিক্ষক নামের অর্ধশিক্ষিত ও উগ্র গোষ্ঠী মাঠ গরম করছে। আর তারা যা বোঝাচ্ছে তাতেই মজে আছে কথিত শিক্ষিতদের অনেকে। রাজনৈতিক স্বার্থান্বেষীদের কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে সারা পৃথিবীতেই হিজড়ার প্রতিশব্দ হিসেবে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি ব্যবহার হয়। ইসলামিক রিপাবলিক পাকিস্তানে এ সংশ্লিষ্ট আইনের নাম ট্রান্সজেন্ডার এক্ট। অথচ ধর্মান্ধদের দাবির বিপরীতে সরকারও এই শব্দটিকে ইসলামবিরোধী হিসেবে গণ্য করছে!

ট্রান্সজেন্ডারশিপকে যারা সমকামিতা বানাচ্ছে তারা শিশু বলাৎকার নিয়ে কখনো একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। ইতিহাস ও ধর্মীয় বিভিন্ন বই থেকে আমি অগণিত উদাহরণ দিতে পারবো যেখানে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমকামিতাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে নীরব থেকে শরীফ থেকে শরীফা গল্পের মতো সাধারণ একটি বিষয় নিয়ে সোচ্চার হয়েছে জ্ঞানপাপী ও অজ্ঞরা। লৈঙ্গিক পরিচিতির মাঝে যৌন অভিযোজন খোঁজা সুস্থ চিন্তাধারা হতে পারে না।

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ:

হিজড়া বা তৃতীয় লিঙ্গ হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনো দায় নেই। জন্মগতভাবে তৃতীয় লিঙ্গের কারো মাঝে পুরুষত্বের মাত্রা ও বৈশিষ্ট্য বেশি থাকে, কারো মাঝে নারীত্বের। বিষয়টি একই সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক। আবার জন্মের পরই সবাইকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সনাক্ত করা যায় না। শারীরিকভাবে স্বাভাবিক একজন নারী বা পুরুষের সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের পার্থক্য যৌন সক্ষমতার অনুপস্থিতি। অনুরূপভাবে শারীরিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার চিন্তা ও আচরণে পুরুষত্ব বা নারীত্বের মাত্রা কমবেশি থাকে যা মানসিক। তৃতীয় লিঙ্গের মাঝে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরণের সমস্যাই দেখা যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টরা এ অবস্থা অনুধাবন করে বয়ঃসন্ধিকালে যা তার জন্য মারাত্মক মানসিক বিপর্যয়ের কারণও হতে পারে। তৃতীয় লিঙ্গের কেউ যেন এ অবস্থার শিকার না হয় এবং অন্যান্যরা যেন বিরূপ ধারণা পোষণ না করে তা নিশ্চিত করার দায়ভার সমাজের। এ লক্ষ্যে পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা শরীফ থেকে শরীফা গল্পটি কী কারণে বিতর্ক বা সমালোচনার বিষয়বস্তু হয়েছে তার একটি যৌক্তিক কারণও আমি খুঁজে পাইনি। গোটা বিষয়টি লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কিত। যেখানে যৌনতাই অনুপস্থিত সেখানে কাম বা সমকাম আনা হচ্ছে কোন বিবেচনায় তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।

ট্রান্সজেন্ডারশিপ ইস্যু:

জেন্ডার পরিবর্তন একটি মেডিকেল প্রসিডিউর। সৌদি আরব, মরক্কো, আরব আমিরাত, মিশর, কুয়েত, জর্ডান সহ প্রায় সবদেশেই লিঙ্গ পরিবর্তনের অনুমোদন রয়েছে। সেসব দেশে এ প্রক্রিয়াকে ইসলামবিরোধী হিসেবে গণ্য করা হয় না।

জিনগত কারণে মানুষ শারীরিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে জন্ম নিতে পারে। দৃষ্টি বা শ্রবণ প্রতিবন্ধী বা অটিস্টিক সমস্যার মতো মানুষের মধ্যে অনেক ধরণের শারীরিক বা মানসিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। কেউ তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবেও জন্মগ্রহণ করতে পারে। আবার স্বাভাবিক জন্মের কয়েক বছর পরেও কেউ তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সনাক্ত হতে পারে। সাধারণত নারী ও পুরুষের XX ও XY ক্রোমোজোম থাকে, তৃতীয় লিঙ্গের ক্ষেত্রে XX, XY, XXX, XXY ইত্যাদি বিভিন্ন ভেরিয়েশন থাকতে পারে। আবার XY ক্রোমোজোমে ফিমেল জেনিটাল বা XX সত্ত্বেও জরায়ু নেই এমনও ঘটে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে হরমোনের প্রভাবে তাদের কারো মাঝে মেয়েলি, কারো মাঝে পুরুষালী আচরণ ও শারীরিক বৈশিষ্ট্যের আধিক্য প্রতীয়মান হয়। একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ অন্যদের মতোই মর্যাদা পাওয়ার অধিকার রাখেন। তাই তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে না থেকে কেউ নারী বা পুরুষে রূপান্তরিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শারীরিক এ প্রক্রিয়াটি চিকিৎসাবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট যেখানে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের অযাচিত নাক গলানো অনুচিত।

বলা প্রয়োজন লিঙ্গ রিএসাইনমেন্ট সার্জারি একটি জটিল, সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। শখের বশে বা অভিজ্ঞতা নেওয়ার জন্য কেউ এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে না। সবচেয়ে বড় কথা কেউ চাইলেই লিঙ্গ পরিবর্তন করতে পারে না। আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রমাণ উপস্থাপন করে অনুমতি সাপেক্ষে সার্জারির অনুমতি দেওয়া হয়।

অমানবিক ও মুর্খতাপূর্ণ অভিযোগ:

জেন্ডার বা লিঙ্গ এবং সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন বা যৌন অভিযোজন দুটি ভিন্ন বিষয়। জেন্ডার বলতে নারী, পুরুষ ও ট্রান্সজেন্ডার (তৃতীয় লিঙ্গ) বোঝায়। কেউ যদি লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষ বা নারীতে পরিণত হয় সেক্ষেত্রে সমকামিতার মাত্রা সাধারণ মানুষের তুলনায় সর্বনিম্ন থাকার কথা। কারণ তেমন আকাঙ্ক্ষা থাকলে লিঙ্গ পরিবর্তনের মতো ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রয়োজন হতো না।

পুরুষ বা নারী স্বাভাবিক নিয়মে বিপরীতে লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকে। তবে আদিকাল থেকে এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। কিন্তু এই সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন যদি সমলিঙ্গের প্রতি হয় তার দায়ভার তৃতীয় লিঙ্গের ওপর কেন বর্তাবে? গে বা লেসবিয়ান হিসেবে যারা পরিচিত তাদের জেন্ডার নির্ধারিত। লিঙ্গ পরিবর্তন না করে বা নিজ নিজ লৈঙ্গিক পরিচয় বহাল রেখেছে বলেই তাদের সম্পর্ককে সমকাম বলা হচ্ছে । এর সঙ্গে তৃতীয় লিঙ্গের সম্পর্ক কী?

লিঙ্গ পরিবর্তন বা জেন্ডার রিএসাইনমেন্ট একটি মেডিকেল প্রসিডিউর। যেসব হাদিসের দোহাই দিয়ে এর বিরোধিতা করা হচ্ছে তাতে বিপরীত লিঙ্গের অনুকরণ বা বেশভূষা ধারণের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। আর আপত্তির কারণ যদি হয় কুদরতের লঙ্ঘন, তাহলে হার্ট, লিভার, কিডনি সহ সকল সার্জারি বা ট্রান্সপ্ল্যান্টই হারাম হবে। বহু মানুষকে ভেন্টিলেশনে রেখে বাঁচানো হয়। কিন্তু ভেন্টিলেশনে না রাখলে তার মৃত্যু হতো অবধারিত। তথাকথিত ফতোয়া অনুসরণ করলে ভেন্টিলেশনের মতো চিকিৎসা বিজ্ঞানের বহু আধুনিক পদ্ধতিকে হারাম ঘোষণা করতে হবে। ইংরেজি শিক্ষা, ছবি তোলা, ভিডিও করা ইত্যাদি একসময় হারাম ছিল। হারাম কী করে হালাল হয়ে গেছে? তবে কি এই মর্মে ফতোয়া প্রদানকারীদের চিন্তা-ভাবনার সীমাবদ্ধতা ছিল? তা-ই যদি হয় তাহলে যারা ট্রান্সজেন্ডারশিপ নিয়ে আপত্তি তুলছেন তারা সেই গোত্রেরই অন্তর্ভুক্ত। আর যারা এতে সমকামিতা খুঁজছেন তারা মনগড়া অভিযোগ তুলে আমলনামায় গুনাহের পাল্লা ভারী করছেন।

পরিশেষে বলবো, শরীফ থেকে শরীফার গল্প পড়ে কেউ যদি নিজের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন বা এতে সমকামিতা খুঁজে পান তার উচিত যৌন বিশেষজ্ঞ ও মনোবিজ্ঞানীর শরণাপন্ন হওয়া। তার মাঝে হরমোনাল ইমব্যালেন্স আছে বলে এমন ভাবনার উদয় হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *