নাস্তিকতা মতামত

বনু কুরাইজার গণহত্যা

বীপেন রাজবংশী, যুক্তরাজ্য

নব ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ অভিশাপ হচ্ছে যুদ্ধ, গণহত্যা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং বিধর্মী বা অন্য জাতির মানুষকে দাসে পরিণত করে তাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার ভয়াবহ অমানবিক প্রথা। যুগে যুগে কোটি কোটি মানুষকে এই নির্মম গণহত্যার শিকার হতে হয়েছে। ধর্ষিত হওয়া কিংবা কারো দাস হিসেবে বেঁচে থাকা যে কী ভয়াবহ ব্যাপার, তা হয়তো আমরা আধুনিক সভ্য সমাজে বসবাস করে অনেকেই অনুধাবন করতে পারবো না। কিন্তু নির্মম সত্য হচ্ছে, মানব সভ্যতার ইতিহাস তৈরি হয়েছে এগুলোর ওপর ভিত্তি করেই। মন্দের ভাল ব্যাপার হচ্ছে, আমরা সেগুলো অনেকটাই পেছনে ফেলে এসেছি। এখন আমরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শান্তিপূর্ণ একটি পৃথিবী কামনা করি। তাই আধুনিক মানবিক মানুষ মাত্রই যুদ্ধ বিরোধী, গণহত্যা কিংবা যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো, ধর্ষণ কিংবা যেকোন ধরণের যুদ্ধাপরাধের বিরোধী।আমাদের এখন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ রয়েছে, জেনেভা কনভেনশন এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা আমরা যুদ্ধের সময় যেন যুদ্ধরত পক্ষগুলো বিপক্ষের মানুষের সাথে মানবিক আচরণ করে, তার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারি। সবসময় যে তা সম্ভব হয় তা নয়, এখনো অনেক দেশেই যুদ্ধে পরাজিত সৈন্য এবং জনগণকে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু আমরা সেগুলো বন্ধ করার জন্য এবং নির্যাতনকারী গোষ্ঠীগুলোকে বিচারের সম্মুখীন করার জন্য আন্দোলন করতে পারি। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের আমরা বিচার করতে পেরেছি, বাঙলাদেশে পাক আর্মি এবং রাজাকার আলবদরদেরও আমরা বিচারের সম্মুখীন করতে পেরেছি। তারপরেও অনেক সময় আমরা অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করতে পারি নি, কিন্তু সেটি কোন অবস্থাতেই অন্য কোন অপরাধের জাস্টিফিকেশন হতে পারে না। আমরা এভাবে বলতে পারি না যে, অমুক দেশে যুদ্ধবন্দীদের রেইপ করা হয়েছে, গণহত্যা চালানো হয়েছে, তাই আরেকটি যুদ্ধে যুদ্ধবন্দীদের রেইপ করা বা গণহত্যা চালানো জাস্টিফায়েড!

নবী মুহাম্মদ মক্কায় যখন প্রথম ধর্ম প্রচার শুরু করেন, তখন শুধুমাত্র কয়েকজনকে তার ধর্মে আনতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সময়ে তার না ছিল দলবল, না ছিল যুদ্ধ করার সামর্থ্য। মদিনায় হিজরত করেই নবীর ভাগ্যের পরিবর্তন হতে শুরু করলো। তিনি নিয়মিত বানিজ্য কাফেলা আক্রমণ করে বানিজ্য কাফেলার মালামাল লুট করতে শুরু করলেন, যা তার শক্তিসামর্থ্য বৃদ্ধি করছিল। মদিনায় ইহুদিদের কাছে সাহায্য সহযোগিতা পেয়ে নবীও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠছিলেন। এরপরে তিনি ধীরে ধীরে ইহুদি গোত্রগুলোকে আক্রমণ করতে শুরু করেন। তবে তার বৃহৎ পরিকল্পনা এরকমই ছিল যে, তিনি মদিনা থেকে তার অপছন্দের গোত্র ও মানুষগুলোকে ধীরে ধীরে বিতাড়িত করবেন।

মদিনার আশেপাশে সেই সময়ে বেশ কয়েকটি ইহুদি গোত্র ছিল, যাদের মধ্যে প্রধান ছিল বনু কায়নুকা, বনু নাদির এবং বনু কুরাইজা। মুহাম্মদ প্রথমে বনু কায়নুকা গোত্রকে আক্রমণ করে, এরপর বনু নাদির এবং এরপরে বনু কুরাইজা গোত্রকে। এখানে উল্লেখ্য যে, বনু নাদির গোত্রকে আক্রমণের মাঝখানে মুহাম্মদ হুট করে কোন কারণ ছাড়াই বনু কুরাইজা গোত্রকেও আক্রমণ করে বসেছিল।

নবী মুহাম্মদ বনু কুরাইজা গোত্রে আক্রমণের আগে বেশ কিছুদিন ধরেই অজুহাত খুঁজছিলেন, একটি বড় ধরণের গণহত্যা চালাবার, যাতে তিনি ঐ অঞ্চলে ত্রাস সৃষ্টি করতে পারেন এবং সমস্ত আরব উপদ্বীপে যেন তার নাম আতঙ্ক হয়ে ছড়িয়ে যায়। তার অংশ হিসেবেই তিনি বেশ কয়েকটি ইহুদি গোত্রকে আক্রমণ করেন, উচ্ছেদ এবং বিতাড়িত করেন।

বদর যুদ্ধে জয়লাভের পরে মুসলিম যোদ্ধাগণ ইহুদিদের নানারকম ভয়ভীতি দেখাতো, হুমকিধামকি দিতো। বলতো যে, ইসলাম কবুল না করলে ঐ ইহুদিদেরও একই অবস্থা হবে।

বনু কুরাইজা এবং বনু নাদিরের ওপর নবী মুহাম্মদ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আক্রমণ পরিচালনা করেছিল বিশ্বাসঘাতকতার বদলা স্বরূপ। কিন্তু সেই বিশ্বাসঘাতকতার আসলে কি কোন বাস্তব প্রমাণ ছিল? নাকি শুধুমাত্র ফেরেশতা জিব্রাইল এসে নবীকে সেই বিশ্বাসঘাতকরার কথা জানিয়ে দিয়েছিল, যা আর কেউই দেখেনি বা শোনেনি! ইসলামের পক্ষের লোক নির্লজ্জের মত অনেকেই দাবী করেন যে, এই গোত্রগুলো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল! অথচ এইসব গোত্রের বিশ্বাসঘাতকতার কোন বাস্তব প্রমাণই নেই। সবই ফেরেশতা জিব্রাইলের কাছ থেকে জানা, যেগুলোর সত্যতা যাচাই করার কোন উপায় নেই। এই গোত্রগুলো সেই আক্রমণের আগে না কোন মানুষ মেরেছিল, না নবীর কোন শারীরিক ক্ষতি করেছিল! বনু কুরাইজার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। নবীকে জিব্রাইল এসে বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকতার কথাটি জানিয়ে দেয়, যার কারণে নবী তাদের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে! অর্থাৎ বাস্তব কোন প্রমাণ নেই।

ইসলামের সপক্ষের লেখকগণ নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে বলার চেষ্টা করেন যে, বনু কুরাইজা চুক্তিভঙ্গকারী, বিশ্বাসঘাতক, তাই নবী তাদের উপযুক্ত শাস্তিই দিয়েছিল! অথচ, বনু কুরাইজার সাথে আদৌ নবীর কোন চুক্তি ছিল, সেরকম কোন শক্তিশালী প্রমাণই পাওয়া যায় না।

প্রহসনের এক বিচার চালিয়ে বনু কুরাইজা গোত্রের ৬০০-৯০০ ব্যক্তিকে রীতিমত উল্লাসের সাথে হত্যা করা হয়। আবু দাউদ শরীফের ৪৪০৪-৫ নম্বর হাদিসে ৬০০-৯০০ বনু কুরাইজা গণহত্যার নৃশংস বর্ণনা আছে। যেখানে বলা হয়েছে, যুদ্ধ বন্দী বালক ও শিশুদের গোপনাঙ্গ ও গুপ্তকেশ পরীক্ষা করে নির্বিচারে গণহত্যা করা হয়েছে, এবং দাস বানানো হয়েছে । হাদিসের মানঃ সহীহ

কিন্তু সেইসব দাসদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? তাদের কিছু অংশ নবী মুহাম্মদের নির্দেশেই বিক্রি করে সেই মূল্য দিয়ে অস্ত্র এবং ঘোড়া কিনেছিলেন নবী মুহাম্মদের অনুসারীরা।

ইবনে ইসহাকের সিরাতে রাসুলাল্লাহ গ্রন্থে গনিমতের মাল ভাগাভাগির আরো পরিষ্কার বিবরণ পাওয়া যায়। সেখান থেকে জানা যায়, নবী মুহাম্মদ লুটের মালের এক পঞ্চমাংশ নিজের জন্য রেখেছিলেন, এবং রায়হানা নামক এক নারী যৌনদাসীও নিয়েছিলেন। নবী মুহাম্মদ তাদের গোত্রের সকল সাবালক পুরুষকে হত্যা করতেই চেয়েছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ বিন উবাইয়ের কারণেই নবী এই কাজটি করতে সক্ষম হন নি। বনু কুরাইজার ভাগ্যে যা ঘটেছিল সেটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা এবং এথনিক ক্লিনজিং।  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *