লিখেছেন গাজী সাইফুল / by Gazi Saiful at 12:09 PM on 14 January 2025
কোটা বিরোধী আন্দোলন থেকে সূত্রপাত হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অতঃপর জুলাই আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সেনা সমর্থিত অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায়। জলঘড়ির সময় গড়িয়ে চলেছে; আর এই সময়ের সাথে সাথেই রাজনীতির আয়নায় জুলাই বিপ্লব, ডিক্টেটর শেখ হাসিনার বিদায়ের সাথে সাথেই অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে সেনা সমর্থিত অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকার ব্যবস্থার হাত ধরে কোন পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ?
৯২ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে ধর্ম চর্চা, ধর্মীয় ফতোয়ায় গৎবাঁধা ইসলামী যত ভাবধারার আড়ালে গত ১৭ বছরে সহিংস হতে থাকা মৌলবাদ এখন রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাংলাদেশের বহুল আলোচিত প্রথম সারির একটি দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলোর ১২ই সেপ্টেম্বরের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, ৫-২০ আগস্ট; হামলার শিকার সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১০৬৮। এ ছাড়াও গত (২৯ অক্টোবর) গাজীপুরের শ্রীপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের এক সন্ন্যাসীর বসতভিটায় হামলা করে গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এমন নারকীয় হত্যাকণ্ডের পর রাষ্ট্রের ভূমিকা কি?
শুধুমাত্র ঝড়ে যাওয়া হাজারো প্রাণ রক্তস্নাত বিপ্লবের উপসংহার নয়; বিপ্লব উদ্ভাসিত হয় নতুন চিন্তা ও উপলন্ধির হাত ধরে। গত আওয়ামী সরকারের শাসনাম ,মলে এই দেশে পরম্পরায় বসবাস করে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় নির্যাতনের শিকার হলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরব ভুমিকা এবং সরকারে থাকা ইসলামপন্থী কতিপয় ছাত্র-নেতাদের হাত ধরেই আবারো প্রকাশে ধর্মীয় উগ্রবাদী সংগঠনগুলো। সম্প্রতি মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র-শিবির, হেজবুত তাহ্রীর, শাহাদাত-ই-আল হিকমা, হেফাজতে ইসলাম, হরকাতুল জিহাদের মত সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে। এ ছাড়াও গত ১১ অক্টোবর বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরের রহমত গঞ্জের জে এম সেন হলের মাঠে অনুষ্ঠিত পূজামন্ডপে ছয় যুবককে স্টেজে উঠে ইসলামী সংগীত গাইতে দেখা গেছে। যা দেশজুড়ে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দেয়। এটি ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীও অনুভূতিতে আঘাত।
গত ৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং দেশের একটি সুনির্দিষ্ট অবহেলিত অংশ (সমকামী, গে, লেসবিয়ান) এদের অধিকারের উপর আগ্রাসন চালানো হয়। উপরোক্ত বিষয়গুলো একজন উদার মুসলিম হিসেবে আমার চিন্তা এবং মানুষের মানবাধিকারের পক্ষে নিজের উপলব্ধিকে আহত করে মারাত্মকভাবে এবং বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের অবস্থান নিয়ে দুঃশ্চিন্তার জন্ম দেয়। উপরন্তু, নিজের মুসলিম সত্বাও ইসলাম বা ইসলামের এহেন উগ্র রূপ থেকে সরে যেতে পাকাপাকিভাবে প্রলুব্ধ হয়।
গত ১০ই সেপ্টেম্বর এক সময়ের নিষিদ্ধ মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর এবং ৭১ এ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ৯০ বছরের দন্ডপ্রাপ্ত প্রয়াত গলাম আযমের পুত্র অবসরপ্রাপ্ত বিগ্রেডিয়ার জেনারেওল আব্দুল্লাহিল আমান আযমী বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের বিষয়ে মতামত ব্যক্ত করেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক রচিত এই সংগীতকে কবির ধর্ম পরিচয় সামনে নিয়ে এসে এটিকে হিন্দুয়ানী সংগীত বলে উল্লেখ করেন। দেশের সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের উপর এটি মৌলবাদের সাড়ম্বরে আত্মপ্রকাশ। যা গত ১৭ বছরের আওয়ামী শাসনামলে ধৃষ্টতা দেখানোর সুযোগ না থাকলেও এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মৌলবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করছে। এমন বিদ্বেষী ধর্মীয় অন্ধত্বকে সামনে রেখে মন্তব্য করলেও এর বিরুদ্ধে নিরব ভূমিকায় ছিলো সরকার।
সমকামী সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের ইসলামী ভাবধারার সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিগৃহীত করছে যুগের পর যুগ ধরে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের অসহযোগিতামূলক আচরণে সমকামীদের নিরাপত্তা আগেও চেয়েও খারাপ হয়েছে। সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ একটি জৈবিক প্রক্রিয়ার ফসল; কিন্তু নিজের এই জৈবিক স্বরূপ, তার আত্মপ্রকাশ ও ব্যক্তি স্বাধীনতা উপেক্ষিত। এমনকি অবহেলিত এই সম্প্রদায়ের অধিকারের পক্ষে যে/ যারাই সবর থাকার চেষ্টা করেছেন, ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদীদের দ্বারা প্রাণের শঙ্কায় পড়েছেন। বাংলাদেশের সমকামীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন জুলহাজ মান্নান। ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম নির্মম ভাবে হত্যা করে তাকে। সে সময় তিনি এলজিবিটিদের নিয়ে রুপবান নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। কিন্তু বিশ্বের উন্নত দেশ যুক্তরাজ্য সহ বিভিন্ন দেশে এই সম্পকামী, উভকামী সম্প্রদায়ের অধিকারকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়। সেখানে এই সম্প্রদায় নিজেদের পূর্ণ স্বাধীনতা উপভোগ করেন। অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে এধরণের গোষ্ঠীগুলোর উপর চড়াও হয় বিবিধ অন্যায় আইনের সুযোগ নিয়ে। ফৌজদারী দন্ডবিধির এবং অন্যান্য আইনের প্রাসঙ্গিক ধারাগুলো বাতিলযোগ্য বিবেচনা করা উচিৎ বাংলাদেশকে মধ্যযুগীয় সমাজ-ব্যবস্থা হতে বেরুতে হলে।
বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকার রাজু ভাস্কর্যের নারীর মাথায় কালো হিজাব পড়িয়ে দিতেও দেখা গেছে মৌলবাদী সম্প্রদায়কে। দেশের প্রতিটি ভাস্কর্যের সাথে জড়িয়ে আছে সংগ্রামী ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কিন্তু গত ৫ই আগস্টে সরকার পতনের পর ছাত্র আন্দোলনে থাকা দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহকে দেখা গিয়েছে আগ্রাসী ভূমিকায়। দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকা সকল ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তাদের নেতৃত্বে। বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির নিদর্শন দেয়াল চিত্রগুলো ও শিল্পকলা পুরোপুরি ভাবে নষ্ট করে দেয়া হয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় থাকা এই ছাত্র সমন্বয়করা ধর্মীয় উগ্রবাদীদের মতোই পন্থা বেছে নিয়েছে। যে কোন ধরণের সমালোচনা এবং বিরোধী মত
দমনে রাষ্ট্রীয় শক্তির ব্যবহার করছে বা ঝাঁপিয়ে পড়ছে বিরোধী মতামতধারীদের ওপর, যা একটি বৈষম্যহীন নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে অন্তরায়।