Opinion Politics

ধর্ম অবমাননা, সাম্প্রদায়িকতা এবং মূর্তি ভাঙ্গার সুন্নত

লিখেছেন -আব্দুল্লাহ আল হোসাইন

রতের বাবরি মসজিদ ভাঙার সময় আমার বয়স ছিল অল্প। ছোট হলেও সেই সময়ের কথা বেশ স্পষ্ট মনে আছে। কারণ সেই দাঙ্গার ঢেউ বাঙলাদেশেও আঘাত করেছিল। সে সময়ে বয়সে ছোট ছিলাম, বাবা মা বলে দিয়েছিল আমি হচ্ছি মুসলমানের পোলা। নির্মোহ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সবকিছু যাচাই করা তখনো শিখিনি। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিক্রিয়া হিসেবে বাঙলাদেশেও তখন মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি হতে থাকে। আমরাও হিন্দুদের মূর্তি ভাঙলে বন্ধুদের সাথে খুবই আনন্দ করতাম। হাসতে হাসতে বলতাম, মালাউনদের মূর্তিগুলোর এত ক্ষমতা থাকলে মূর্তিগুলো নিজেদের রক্ষা করে না কেন? সেই সময়ে একবারও মনে হতো না, বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময় আল্লাহও কিন্তু ছিল নিশ্চুপ! সারা পৃথিবীতে শত শত মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়, তখনও আল্লাহর কোন খোঁজখবর পাওয়া যায় না। এমনকি, কাবাতেও কয়েকবার আক্রমণ হয়েছিল, কাবা কয়েকবার ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়াও হয়েছিল। সেই সময়ও আল্লাহ কাবাকে রক্ষা করতে পারেনি! সেই সময়ে এগুলো একবারও মাথায় আসতো না। শুধু মনে হতো, হিন্দুদের দেবদেবীর ক্ষমতা থাকলে তারা তো মন্দিরগুলো রক্ষা করতেই পারতো!

তখন হিন্দুদের ওপর রাগে ক্ষোভে গা রি রি করতো। ইচ্ছে হতো বাঙলাদেশে বসবাসকারী সব হিন্দুকে ঘাড় ধরে ভারত পাঠিয়ে দেই। বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিশোধ নিই। সবার মুখে শুনতাম, আমাদের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। তাহলে হিন্দুরা কোন সাহসে এই দেশে বসবাস করে, সেটাই বুঝতাম না। বন্ধুদের সাথে বলাবলি করতাম, হিন্দুরা কত খারাপ, হিন্দুরা কত সাম্প্রদায়িক, কত নিকৃষ্ট। তারা ভারতে মুসলমানদের ওপর কতই না অত্যাচার চালাচ্ছে! অন্যদিকে আমরা কত ভাল, কত মহান! আমাদের দেশে হিন্দুরা তো প্রায় রাজার হালে আছে, এইসব আলোচনা। এগুলো বলতে বলতে পাশের বাসার হিন্দু বন্ধুটাকে আর খেলায় নিতাম না। কারণ ওদের উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার। বলতাম, শালারা আমাদের দেশে থাকে এই তো অনেক বেশি। আবার খেলায় নেয়ার দরকার কী? আমরা মুসলমানরা অনেক ভাল, মহৎ আর অনেক অসাম্প্রদায়িক বলেই তো তারা আমাদের দেশে থাকতে পারছে! ভারতের হিন্দুদের মত যদি আমরা সাম্প্রদায়িক হতাম, তাহলে এদেশে ধরে ধরে হিন্দুদের জবাই করে ফেলতাম! আমাদের এলাকার এক বড় ভাই বলতো, মালাউন কা বাচ্চা, কাভি নেহি আচ্ছা। যো ভি আচ্ছা, ও ভি শুয়ার কি বাচ্চা।

সেইসময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন বুদ্ধিজীবীর কলাম পড়তাম। সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা লিখতেন, ইসলাম এসব ভাঙ্গাভাঙ্গি একদম সমর্থন করে না। ইসলাম সকল ধর্মকে সম্মান এবং শ্রদ্ধা করে। অন্যের ধর্ম পালনের অধিকার দেয়। তারা লিখতেন, নবীজি নাকি অন্য ধর্মের মানুষকে মূর্তি পুজার অধিকারকে সম্মান জানাতেন। এসব পড়ে পরবর্তীতে কিছুটা অসাম্প্রদায়িক হওয়ার চেষ্টা করতাম, কিন্তু ওয়াজে গিয়ে আবার শুনতাম ভিন্ন কথা। ওয়াজীরা বলতেন, মূর্তি ভাঙ্গা হচ্ছে নবীর সুন্নত। তাই মূর্তি ভেঙ্গে ফেলতে হবে। পৃথিবীতে আল্লাহর একচ্ছত্র এবং নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এসব শুনে দ্বিধায় পড়ে যেতাম। আসলে কোন কথাগুলো সত্য?

ইসলাম কী আসলেই অন্য ধর্মের মানুষের মূর্তি পুজার অধিকারকে সম্মান দেয়? ইসলাম কী মূর্তি ভাঙ্গার অনুপ্রেরণা দেয়? পৌত্তলিকদের পুজনীয় মূর্তি ও মন্দির ভাঙ্গা আসলেই কী নবীর সুন্নত? আজকের এই লেখাটিতে সেই বিষয়েই আলোকপাত করা হবে।

মুসলিমগণ প্রায়শই দাবী করেন, তাদের নবীকে সকলের সম্মান এবং শ্রদ্ধা করতে হবে। কেউ নবী মুহাম্মদের কার্টুন আঁকলে, ছবি বানালে, মুসলিম উম্মাহ উন্মাদের মত তাদের গলা কাটে। শার্লি এবদো নামক ফরাসী কার্টুন ম্যাগাজিনের ১২ জন কার্টুনিস্টকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে কিছু মুসলিম সন্ত্রাসী হত্যা করেছিল। এই কয়েকদিন আগেই, ক্লাসরুমে বাক স্বাধীনতা বিষয়টি পড়াবার সময়ে ফ্রান্সের একজন শিক্ষক শার্লি এবদোর কিছু কার্টুন ক্লাসরুমে দেখিয়েছিল। ফলশ্রুতিতে তাকেও হত্যা করেছে এক চেচেন মুসলিম। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবেই ফ্রান্স এই কার্টুনগুলো বিভিন্ন দেয়ালে প্রদর্শন করতে শুরু করে। ফ্রান্সের দেয়ালে দেয়ালে এখন শার্লি এবদোর কার্টুন শোভা পাচ্ছে। নবী, পোপ, হিটলার, ট্রাম্প, এমনকি, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকেও তারা ছেড়ে কথা বলে না। এই নিয়ে বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব উত্তাল। তারা দাবী জানাচ্ছে, তাদের ধর্মের নবীকে সম্মান করতে হবে। অথচ, অন্য ধর্মের মূর্তি ভাঙ্গার সময় বিষয়টি কী তাদের মনে থাকে? উল্লেখ্য, তারা যে সব দেশই এই পর্যন্ত দখল করেছে, প্রায় সব দেশেই প্রাচীন মূর্তি এবং মন্দিরগুলো একদমই ধ্বংস করে ফেলেছে। আফগানিস্তানে তালেবানদের ২০০০ বছর পুরনো বৌদ্ধ মূর্তিগুলো ধ্বংস করার মত ঘটনা অসংখ্যবারই ঘটেছে [1], আইসিসও কম যায় নি [2]। বাঙলাদেশে তো মূর্তি আর মন্দির ভাঙ্গাভাঙ্গি প্রতি মাসের ব্যাপার। কিন্তু এই মূর্তি ভাঙ্গা কী ইসলাম সম্মত?

একজন হিন্দুর কাছে দূর্গা কিংবা শিব বা কালীর মূর্তিও কিন্তু সম্মানিত এবং পবিত্র বিষয়। বাঙলাদেশে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই নানা মন্দিরে মূর্তি ভাঙ্গা হয়। ওয়াজে হুজুররা প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মূর্তি ভাঙ্গার উষ্কানি দেন। অথচ, ইসলামের বিধান হচ্ছে, কেউ যদি নবী মুহাম্মদের সামান্যতম সমালোচনাও করে, তাকে বিনা বিচারে যেকোন মুসলিম গিয়ে জবাই করে আসতে পারে। ইসলামে শাতিমে রাসুলের শাস্তি দিতে কোন বিচার আচারের প্রয়োজন নেই। এর মানে হচ্ছে, মুসলিমরা ঠিকই অন্য ধর্মের অবমাননা করতে পারবে, কিন্তু অন্য কেউ ইসলামের বিষয়ে কিছুই বলতে পারবে না। অন্য ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করা নাকি তাদের ধর্মীয় অধিকার! আসুন কয়েকটি ভিডিও দেখি, যেখানে অমুসলিমদের পুজনীয় মূর্তি ভাঙ্গার প্রকাশ্যে উষ্কানি দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, এরকম ওয়াজের সংখ্যা লক্ষাধিক। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি দেখানো হচ্ছে

ইসলাম ধর্মের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নবীর নাম হচ্ছে ইব্রাহীম। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন একটি পৌত্তলিক পরিবারে। তার পিতা ছিল মূর্তি পুজারী। তিনি সেই ছোটবেলা থেকেই লুকিয়ে পৌত্তলিকদের মূর্তি ভেঙ্গে আসতেন। পৌত্তলিকদের মূর্তি ভাঙ্গার অনেকগুলো গল্প ইসলামের নানা গ্রন্থে খুব মহান এবং বীরত্বের কাজ হিসেবে বর্ণিত আছে। ইব্রাহীম কীভাবে মূর্তিপুজারীদের মূর্তি ভেঙ্গে তা নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতেন, অন্য ধর্মের মানুষকে অপমান অপদস্থ করতেন, অন্য ধর্মের অবমাননা করতেন, সেগুলো কোরআন হাদিসের নানা জায়গায় পাওয়া যায়।

ইসলামিক সূত্রগুলো থেকে জানা যায়, ইব্রাহীমের সম্প্রদায় দেবদেবীর পুজা করতো। একদিন তিনি কেন্দ্রীয় দেবমন্দিরে গিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার সংকল্প করলেন।

ইবরাহীমের সম্প্রদায় বছরের একটা দিনে উৎসব পালন করত। নবী ইব্রাহীম খুব কৌশলে অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে সেখানে যেতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। তার পরিকল্পনা ছিল, এই সুযোগে দেবমন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়া। সবাই চলে গেলে তিনি মন্দিরে ঢুকলেন এবং দেব-দেবীদের কুড়াল দিয়ে ভীষণ জোরে আঘাত করে সবগুলোকে গুঁড়িয়ে দিলেন। তবে বড় মূর্তিটাকে পূর্বাবস্থায় রেখে দিলেন। মেলা শেষে লোকজন ফিরে আসলো এবং মন্দিরে গিয়ে প্রতিমাগুলির অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে গেল। তারা বুঝে গেল, এগুলো ইব্রাহীমেরই কাজ। ইব্রাহীম তখন বলতে লাগলো, ঐ বড় মূর্তিটিই এই কাজ করেছে। সেই সাথে এটিও বললো, মূর্তিগুলোর ক্ষমতা থাকলে নিজেদের রক্ষা করলো না কেন? যেসব মূর্তির নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা নেই, তারা কীভাবে মানুষকে রক্ষা করবে? কথাগুলো যৌক্তিক হলেও, ধর্ম অবমাননা নিঃসন্দেহে। একই যুক্তি কিন্তু মসজিদ ভাঙ্গা কিংবা কোরআন পোড়াবার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা যায়।

অর্থাৎ, ইসলাম ধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ একজন নবী, উনি নিজেই বাপদাদার ধর্ম, তার গোত্রের সংস্কৃতি ও বিশ্বাস নিয়ে চরমভাবে ঠাট্টা তামাশা, কটাক্ষ, অবমাননা এগুলো সবই করতেন। তবে ইসলাম ধর্মকে নিয়ে ঠিক একইভাবে কটাক্ষ, কটূক্তি, সমালোচনা কী করা সম্ভব?

ইসলাম ধর্মের প্রধান নবী মুহাম্মদ পৌত্তলিকদের দেবদেবী, পূর্বপুরুষদের ধর্ম, এগুলো সম্পর্কে অবমাননাকর কটূক্তি করতো বলেই ইসলামিক সূত্রগুলো থেকে পরিষ্কারভাবেই জানা যায়। মক্কায় সেই সময়ে তাকে ধর্মদ্রোহীতা দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তার ওপর অভিযোগ ছিল-তিনি প্রচলিত ধর্মকে অসম্মান এবং অবমাননা করেছেন। সমাজে শত শত বছর ধরে প্রচলিত ধর্মের সমালোচনা, বাপদাদার ধর্মের অবমাননা, কটূক্তি, দেবদেবী নিয়ে অপমানজনক কথা বলার কারণে বারবার তাকে সতর্ক করা হয়। কিন্তু নবী কখনোই ধর্ম অবমাননা থেকে সরে আসেন নি। উল্লেখ্য, উনাকে কিন্তু শুরুতেই আক্রমণ করা হয় নি [4] 

মুসলিমগণ যখনই ক্ষমতাপ্রাপ্ত হবে, তখনই অমুসলিমদের পুজনীয় মূর্তি ধ্বংস করে ফেলা তাদের সকল নবী ও রাসুলের সুন্নাহ। একে অনুসরণ অনুকরণ এবং পালন করাই প্রতিটি মুসলিমের পবিত্র ধর্মীয় কর্তব্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, নবী রাসুলদের এই সুন্নাহ বর্তমান সময়ে পালন করতে গেলে পুরো পৃথিবী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিপুর্ণ হয়ে উঠবে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ এবং যুদ্ধ বিগ্রহের উদ্ভব ঘটবে। অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, যার ফলশ্রুতিতে আমাদের পৃথিবী হয়ে উঠবে অশান্ত। প্রত্যেকেরই অধিকার রয়েছে, যেকোন ধর্মের সমর্থন বা বিরুদ্ধতা করা। প্রতিটি মানুষেরই অধিকার রয়েছে কোন ধর্মের প্রশংসা বা সমালোচনা করা। প্রতিটি মানুষেরই অধিকার রয়েছে কোন ধর্মকে বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস করা। কিন্তু এই অধিকারটি সকলের জন্য প্রযোজ্য। কোন বিশেষ ধর্ম বা নবীর জন্য বাড়তি কোন খাতির এই আইনে থাকতে পারে না। অধিকার থাকলে সকলের থাকবে, নইলে কারোই থাকবে না। মুসলিমরা যদি তাদের নবীর সমালোচনা বন্ধ করতে চায়, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের উচিৎ হবে, কোরআন হাদিস থেকে অমুসলিমদের সম্পর্কে যত বাজে কথা বলা আছে সেগুলো মুছে ফেলা। ইসলাম ধর্ম তো মৌলিকভাবেই অন্য ধর্মের সাথে মিলেমিশে সহাবস্থানকে হারাম মনে করে।

অমুসলিমদের দেশে আল্লাহর উপাসনা যদি অধিকার হয়, মসজিদ বানানো, আজান দেয়া, বোরখা পড়া যদি তাদের অধিকার হয়, মুসলিমদের দেশে অমুসলিমদের মূর্তি পুজার অধিকারও থাকতে হবে। তাদেরও প্রকাশ্যে ধর্ম পালন, নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রকাশ্যে উদযাপন করার অধিকারও থাকতে হবে। কিন্তু মুসলিমরা কখনোই সৌদি আরব বা অন্যান্য ইসলামিক শরীয়ার দেশে অমুসলিমদের ধর্ম পালনের সমান অধিকারটি দিতে ইচ্ছুক নন, কিন্তু তারা অমুসলিমদের দেশে নিজেদের ধর্ম পালনের অধিকার ষোল আনা উশুল করতে উৎসুক। তারা অন্য ধর্মের সমালোচনা, কটাক্ষ, কটূক্তি করার অধিকার চায়- কিন্তু তাদের ধর্ম নিয়ে কেউ কিছু বলতে পারবে না! এই দ্বিচারিতার মধ্যেই তাদের বসবাস। আসলে, ইসলাম ধর্মটি সেই গোড়া থেকেই এরকম। আর জেনে হোক না জেনে হোক, অসংখ্য মুসলিম এগুলোই সমর্থন করে। কারণ, এটি তাদের বাপদাদার ধর্ম!

এ কারণেই সহিহ হাদিসে বর্ণিত আছে, মুমিন হচ্ছে নাকে দড়ি বাঁধা উঠের মত 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *