ইতিহাস ইসলাম ধর্ম তথ্যভান্ডার

আল্লাহর নাম ব্যবহার করে রাসুলের নানাবিধ মিথ্যাচার

লিখেছেন জোবায়ের হোসেন ও  এম ডি জিল্লুর রহমান

ভূমিকাঃ

আল্লাহ বলে কিছু আছে না কি নেই এই তর্কে আমরা আসলে যেতে চাইনা কেননা এটি তর্ক করবার মত কিছু, এমনটা আমাদের কখনো মনে হয়নি। আপনার সাথে যদি এখন কেউ তর্ক জুড়ে দেয় এই বলে যে, মানুষ উড়তে পারে, বা পেঙ্গুইন উড়তে পারে কিংবা গরু উড়তে পারে, আপনি কি তার সাথে তর্ক জুড়ে দেবেন? আপনি যেখানে জানেন যে এসব পুরো ব্যাপারটাই ফালতু ও হাস্যকর কথা সেখানে আপনি তর্কে যাবেন কেন? ঠিক এমনভাবেই আল্লাহ-ভগবান কিংবা গডের অস্ত্বিত্ব রয়েছে কিনা সেই আলাপে যাওয়াটাই আমাদের কাছে বৃথা মনে হয়। এই লেখাটির ভূমিকা আমি (যোবায়ের হোসেন) যখন লিখছি তখন আমি আসলে যে চিন্তা করে লেখা শুরু করেছিলাম যে, এই যে কল্পিত আল্লাহর কথা বলা হয় কিংবা এই যে স্রষ্টার একটা কাল্পনিক রূপ কোরান বা হাদীসের ফরম্যাটে লেখা হয়েছে বা বাধ্য করা হচ্ছে মানুষকে বিশ্বাস করতে সেখানে আসলে কতটুকু মিথ্যে রয়েছে? অর্থ্যাৎ, আল্লাহর মিথ্যেবাদী কথা বা বাণী নিয়ে আমার একটা চিন্তা মাথায় চলে এলো। ফলে আমি এবং আমার বন্ধু এম ডি জিল্লুর, আমরা দুইজন ভেবে বের করলাম কোরান, হাদীস সহ বিভিন্ন বই-পুস্তক ঘেঁটে গবেষনা করে আমরা আসলে আল্লাহর বা এই স্রষ্ঠার নানাবিধ মিথ্যাচারের একটা রূপ সাধারোন মানুষের জন্য বের করে দেখাবো। এতে করে সাধারণ মানুষ এইটুকু সত্যের সামনে এসে দাঁড়াতে পারবেন যে, এই ধর্ম মিথ্যে এবং আল্লাহ বলে যা বলা হচ্ছে তা পুরাটাই অসত্য। 

আমি নিজে সমকামী হবার কারনে আমাকে ধর্মীয় যে নির্যাতন ও যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে তা অবর্ণনীয়। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে আমার পিতার মৃত্যুর সংবাদও আমাকে পেতে হয়েছে অন্যের মাধ্যমে কেননা আমি সমকামী এবং আমার পিতা এটি নিয়ে গর্বিত চিলেন না। লোকজন বলছে আমার কারনে অপমানে ও কষ্টে আমার বাবার শরীর ক্রমাগত খারাপ হয়ে গিয়েছিলো আর এই কারনে তিনি আরো দ্রুত শারীরিক অসুস্থতার দিকে ধাবিত হয়েছিলেন। এইসব কারনেই ধর্মের প্রতি আমার এক প্রচন্ড বিরাগ রয়েছে। যেই আল্লাহ নাকি মানুষকে তৈরী করেছেন সেই আল্লাহ আবার মানুষকে ঘৃণা শেখাবার শত মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছেন তার গ্রন্থে। এইসব আসলে মানা যায়না। এক্টির  সাথে আরেক্টি মেলে।

আমাদের এই যৌথ লেখাতে অনেক গবেষনা করতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে ফলে পাঠকদের কাছে আসতেও সময় লেগে গিয়েছে। আমরা সেই কারনে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে আমরা বিশ্বাস করি, আমাদের এই গবেষনাধর্মী এই লেখাটি আপনাদের ভালো লাগবে এবং অনেক কিছুই আপনারা জানতে পারবেন।

আল্লাহর সমস্ত মিথ্যাচারঃ

ছোটবেলা থেকে গুরুজনদের কাছ থেকে আমরা শুনে এসেছি, “সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা বলিবে না।” এমনকি, নিজের কোন সাময়িক সুখ বা উপকারের জন্য হলেও, সত্যি কথাই বলতে হবে, আর মিথ্যা এড়িয়ে চলতে হবে। ছোটবেলা মায়ের মুখে একটি গল্প শুনতাম, গল্পটি ইসলামের অন্যতম প্রখ্যাত আল্লাহর ওলি বায়োজিদ বোস্তামীর। গল্পটি এরকম ছিল, একবার হযরত বায়েজিদ বোস্তামীকে তার মা কিছু স্বর্ণমুদ্রা জামার গোপন জায়গাতে লুকিয়ে কোথাও পাঠিয়েছে। পথের মধ্যে ডাকাত বোস্তামীকে ধরলো এবং জিজ্ঞেস করলো, তার কাছে অর্থ সম্পদ আছে কিনা। সত্যবাদী বায়োজিদ বোস্তামীকে তার মা শিখিয়েছিল, সদা সত্য কথা বলতে। সত্যের বিজয় হবেই। সর্বদা যারা সত্যের পথে চলে, তারা ছোটখাট সমস্যায় পড়লেও শেষ পর্যন্ত তাদেরই বিজয় হয়। তাই বায়োজিদ বোস্তামী ডাকাত সর্দারের কাছে তার স্বর্ণমুদ্রা থাকার সত্য কথা বলে দিলো। ডাকাত সর্দার অবাক হলো, এবং জিজ্ঞেস করলো সে কেন সত্য বললো! বায়োজিদ বোস্তামী ডাকাত সর্দারকে জানালেন, তার মা তাকে সদা সত্যের পথে থাকতে বলেছেন। এতে সাময়িক ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলেও, শেষ পর্যন্ত সত্যের পথের মানুষেরই জয় হয়। এমনকি, জয় না হলেও, সদা সত্যের পথেই সকলের থাকা উচিত। এইসব গল্পের সত্যতা কতটুকু তা প্রশ্ন সাপেক্ষ, তবে ছোটবেলা থেকে এধরণের ধর্মীয় নেতা পীর আউলিয়াদের গল্প শুনেই আমরা নীতি নৈতিকতার পাঠ নিই। কিন্তু, ইসলামে প্রয়োজন অনুসারে, নিজের লাভের জন্য মিথ্যা বলা কী জায়েজ? ইসলামে কয়েকটি ক্ষেত্রে মিথ্যা বলার অনুমতি দেয়া আছে, সেসব পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখা হবে। আপাতত আমাদের আজকের বিষয় হচ্ছে, আল্লাহ পাক কী কখনো মিথ্যা বলতে পারেন কিনা। আমরা জানি, নিজের লাভের জন্য মিথ্যা বলা অপবিত্র শয়তানের কাজ। প্রশ্ন হচ্ছে, এই কাজটি আল্লাহ পাকও কখনো করেছেন কিনা।

আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা নানা সময়ে মিথ্যা বলি। কিন্তু সেই মিথ্যাগুলো বেশিরভাগ সময়ই হয় আমাদের নানা ধরণের অক্ষমতার জন্য। যেমন ধরুন, আমার সন্তান একটি দামী গাড়ি কিনতে চাইলো। আমি মিথ্যা করে তাকে বললাম, এই গাড়িটি কাল কিনে দিবো। কিন্তু আসলে আমি কাল তাকে কিনে দিবো না। আবার অনেক সময় ভয়ে আমরা মিথ্যা বলি। যেমন ধরুন, একটি অন্যায় আমি করে ফেলেছি। সেই অন্যায় কাজটি গোপন করার জন্য আমরা মিথ্যা কথা বলি। দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি মিথ্যাই হয় আমাদের অক্ষমতার কারণে। একমাত্র বদমাইশ লোকই ক্ষমতা থাকার পরেও মিথ্যা বলে, নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য। কিন্তু আল্লাহর তো কোন অক্ষমতা নেই। তিনি তো চাইলেই সব পারেন। তাহলে তিনি কেন মিথ্যা বলবেন? তিনি কেন নিজের কোন সুবিধা আদায়ের জন্য বদমাইশদের মত মিথ্যা বলবেন?

ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাক হচ্ছেন সকল প্রকারের পাপ মুক্ত, তিনি খারাপ বা অশুভ বিষয় এরকম সকল কিছুর উর্ধ্বে। এমনকি, তার প্রেরিত নবী হচ্ছেন সর্বকালের সর্বযুগের জন্য নীতিনৈতিকতার একমাত্র মানদণ্ড। কিন্তু এই আল্লাহ পাক কিংবা তার নবী কী মিথ্যা বলতে পারেন? ইতিপূর্বে অনেকগুলো লেখাতে নবী মুহাম্মদের নানান কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে, আমাদের আজকের আলোচনা হচ্ছে আল্লাহ পাক সম্পর্কে। আল্লাহ পাক প্রয়োজন অনুসারে কখনো মিথ্যা কথা বলেন কিনা, সেটি যাচাই করে দেখার জন্য।

অনেক সময় অনেক মুসলিম দাবী করেন যে, নবী মুহাম্মদ যা যা বলেছেন প্রতিটি কথাই পরবর্তীতে সত্য হয়েছে। যা ভবিষ্যতবাণী করেছেন, সবই সঠিক প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু এরকম বেশ কয়েকটি উদাহরণ দেখানো যায় যে, নবী মুহাম্মদ যা বলেছিলেন, বা আল্লাহ তাকে যা জানিয়েছিল, সেগুলো পরবর্তীতে ভুল বা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছিল। কিন্তু চতুরতার সাথে নবী মুহাম্মদ সেই কথাটিকে আল্লাহ পাকের মোজেজা হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, আল্লাহ ইচ্ছা করেই নবীর সাহাবীদের ভুল বা মিথ্যা জানিয়েছিল, ভাল কোন উদ্দেশ্যে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আল্লাহ পাক ভাল উদ্দেশ্যেও মিথ্যা কেন বলবেন? মহাবিশ্বের সর্বক্ষমতার অধিকারী আল্লাহ পাকের মিথ্যা বলা কী আদৌ সম্ভব? ঘটনাটি সংক্ষেপে বলছি।

একবার নবী মুহাম্মদ এবং তার সাহাবীগণ যুদ্ধে গিয়েছেন। আল্লাহ পাক এরকম সময়ে নবীকে স্বপ্নে দেখালেন যে, বিপক্ষের কাফেরদের যোদ্ধাদের সংখ্যা অনেক কম। এই স্বপ্ন দেখে তিনি তার সাহাবীদের বিষয়টি জানালেন। সাহাবীরা খুশী মনে যুদ্ধে গেল। যুদ্ধে গিয়ে দেখা গেল বিপক্ষের কাফেরদের সংখ্যা অনেক বেশী। এই যুদ্ধে মুসলিমদের জয় হওয়ার পরে সবাই মুহাম্মদকে জিজ্ঞেস করলো, আল্লাহ তো জানিয়েছিল কাফেররা সংখ্যায় কম। তাহলে তারা সংখ্যায় এত বেশী হলো কীভাবে? উত্তরে মুহাম্মদ সাথে সাথেই একটি আয়াত নাজিল করে ফেললেন এবং তার সাহাবীদের বোঝালেন, আল্লাহ ইচ্ছে করেই এই মিথ্যাটি বলেছিলেন, যেন মুসলিমদের মনোবল অটুট থাকে। যেন তারা ভীত হয়ে পালিয়ে না যায়।

কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাকের কেন এই মিথ্যাটি বলতে হলো, সেটি খুবই হতাশ করা বিষয়। কারণ, সর্বশক্তিমান আল্লাহ চাইলেই একলক্ষ বা এককোটি ফেরেশতা পাঠিয়ে কাফেরদের তুলোধোনা করে ফেলতে পারতেন। তাহলে তার আর মিথ্যা বলার দরকার হতো না। কিন্তু সেটি না করে উনি মুহাম্মদকে মিথ্যা স্বপ্ন দেখালেন, যেন মুহাম্মদের সাহাবীগণ যুদ্ধ করতে যায়। এর অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ প্রয়োজনে মিথ্যাও বলেন। অথবা, মুহাম্মদের ভবিষ্যতবাণী মিথ্যা হয়েছিল, যা ঢাকার জন্য তিনি আল্লাহর আয়াত নামিয়ে ফেললেন! আসুন, কোরআনের আয়াতগুলো পড়ি।

কোরআনে আল্লাহর মিথ্যা বলা

ইসলাম ধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূরা আনফালের ৪৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহ পাক একটি যুদ্ধের সময় মুহাম্মদকে একটি মিথ্যা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল স্বপ্নে দেখা বিষয়টি সত্য নয়। তখন আল্লাহ পাক আরেকটি আয়াতের মাধ্যমে জানালেন, তিনি ইচ্ছে করেই এই মিথ্যা কথাটি বলেছিলেন। যেন সাহাবীদের যুদ্ধের মনোবল অটুট থাকে [1]

স্মরণ কর, আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মাধ্যমে তাদের সংখ্যাকে অল্প করে দেখিয়েছিলেন, যদি তিনি তাদের সংখ্যাকে তোমার নিকট বেশি করে দেখাতেন তাহলে তোমরা অবশ্যই সাহস হারিয়ে ফেলতে আর যুদ্ধের বিষয় নিয়ে অবশ্যইঝগড়া শুরু করে দিতে। কিন্তু আল্লাহ্ই তোমাদেরকে রক্ষা করেছিলেন, অন্তরে যা আছে সে সম্পর্কে তিনি খুবই ভালভাবে অবহিত।
— Taisirul Quran

আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নযোগে ওদের সংখ্যা অল্প দেখিয়েছিলেন, যদি তোমাকে তাদের সংখ্যা অধিক দেখাতেন তাহলে তোমরা সাহস হারিয়ে ফেলতে এবং যুদ্ধ সম্পর্কে তোমাদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হত, কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে রক্ষা করেছেন। অন্তরে যা কিছু আছে সে সম্পর্কে তিনি সবিশেষ অবহিত।
— Sheikh Mujibur Rahman

যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নের মধ্যে তাদেরকে স্বল্প সংখ্যায় দেখিয়েছিলেন। আর তোমাকে যদি তিনি তাদেরকে বেশি সংখ্যায় দেখাতেন, তাহলে অবশ্যই তোমরা সাহসহারা হয়ে পড়তে এবং বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক করতে। কিন্তু আল্লাহ নিরাপত্তা দিয়েছেন। নিশ্চয় অন্তরে যা আছে তিনি সে সব বিষয়ে অবগত।
— Rawai Al-bayan

স্মরণ করুন, যখন আল্লাহ্‌ আপনাকে স্বপ্নে দেখিয়েছিলেন যে, তারা সংখ্যায় কম [১]; যদি আপনাকে দেখাতেন যে, তারা সংখ্যায় বেশি তবে অবশ্যই তোমরা সাহস হারাতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে। কিন্তু আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। আবশ্যই তিনি অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সবিশেষে অবগত।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

[Remember, O Muḥammad], when Allah showed them to you in your dream as few; and if He had shown them to you as many, you [believers] would have lost courage and would have disputed in the matter [of whether to fight], but Allah saved [you from that]. Indeed, He is Knowing of that within the breasts.
— Saheeh International
কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৪৩ )

তাফসীর গ্রন্থে প্রেক্ষাপটের বিবরণ

এবারে আসুন তাফসীরে ইবনে কাসীর থেকে এই আয়াতটির অনুবাদ এবং প্রেক্ষাপট জেনে নিই। লক্ষ্য করুন, তাফসীরে খুব পরিষ্কারভাবেই বলা হচ্ছে, আল্লাহ পাক ইচ্ছাকৃতভাবেই নবী ও তার সাহাবীদের মিথ্যা বলেছিলেন [2] –

৪৩. স্মরণ কর সেই সময়টির কথা যখন আল্লাহ তোমাকে স্বপ্নে দেখাইয়া ছিলেন যে, তাহারা সংখ্যায় স্বল্প, যদি তোমাকে দেখাইতেন যে, তাহারা সংখ্যায় অধিক তবে তোমরা সাহস পাইতে না এবং যুদ্ধের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করিতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদিগের রক্ষা করিয়াছেন। তিনি তো অন্তরের বিষয় সম্পর্কে ভালভাবে ওয়াকিফহাল।

৪৪. স্মরণ কর, তোমরা যখন পরস্পরের সম্মুখীন হইয়াছিলে তখন তিনি তাহাদিগকে তোমাদিগের দৃষ্টিতে সল্প সংখ্যক দেখাইয়াছিলেন, যাহা ঘটিবার ছিল তাহা সম্পন্ন করিবার জন্য। সমস্ত বিষয় আল্লাহর দিকেই প্রত্যাবর্তিত হয়।
তাফসীর : মুজাহিদ বলেন, আল্লাহ পাক মহানবী (সা)-কে স্বপ্নে উহাদের সংখ্যা কম দেখাইয়া ছিলেন। অতঃপর মহানবী (সা) তাঁহার সাহাবাগণকেও ইহা অবহিত করিয়া ছিলেন। সুতরাং উহাদের কাছে ইহাই প্রতীয়মান হইয়াছে। ইবন ইসহাক(র) সহ অনেক লোকই এইরূপ অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। ইবন জারীর (র) উহাদের কোন কোন লোক হইতে বর্ণনা করেন যে, যেরূপ স্বপ্নে দেখা গিয়াছে ময়দানেও অনুরূপ পরিদৃষ্ট হইয়াছে।

ইবন আবূ হাতিম (র) বর্ণনা বলেন : আমাদের নিকট আমার পিতা …. হাসান (র) হইতে … আয়াতাংশ প্রসঙ্গে হাদীস বর্ণনা করিয়াছেন। হাসান বলেনঃ চাক্ষুস কম দেখান হইয়াছে। এই কথা অত্যন্ত দুর্বল ও গরীব। আয়াতে যখন পরিষ্কাররূপে শব্দ (স্বপ্ন) ব্যবহার হইয়াছে তখন দলীল ও যুক্তিহীন ব্যাখ্যার কোন অবকাশ থাকে না।

আলোচ্য … আয়াতের মর্ম হইল, আল্লাহ যদি তোমাদেরকে সংখ্যায় অধিক দেখাইতেন, তবে তোমরা ভীরু হইয়া পড়িতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ দেখা দিত। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে উহাদের সংখ্যায় স্বল্পতা দেখাইয়া তোমাদের সাহস বাড়াইয়া তোমাদিগকে রক্ষা করিয়াছেন।

আলোচ্য … আয়াতাংশের তাৎপর্য হইল, আল্লাহ তোমাদের অন্তরে গোপনকৃত এবং বুকের মাঝে রক্ষিত বিষয় সম্পর্কে পূর্ণরূপেই জ্ঞাত থাকেন। যেমন অন্য এক আয়াতে বলা হইয়াছে, আল্লাহর চক্ষুর গর্হিত কাজ এবং তোমাদের অন্তরের মাঝে গোপনকৃত বিষয় পূর্ণরূপে অবস্থিত রহিয়াছে (৪০: ১৯)।

আলোচ্য … আয়াতাংশের তাৎপর্য হইলঃ আল্লাহ পাক এই আয়াতে তাঁহার নিয়ামতের কথা দ্বিতীয়বার উল্লেখ করিয়াছেন। অর্থাৎ আল্লাহ বলেন: তোমাদেরকে শুধু স্বপ্নেই উহাদের সংখ্যা কম দেখাই নাই। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যখন তোমরা পরস্পর মুখোমুখি হইয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নিতেছিলে, তখনও আমি উহাদের সংখ্যা তোমাদের দৃষ্টিতে স্বপ্ন দেখাইয়াছি। তখন তোমরা বীরবিক্রমে দোয়া পড়িয়া উহাদিগকে পর্যুদন্ত করিয়াছিলে।

আবু ইসহাক সুবাই(র) ইবন মাসুদ (রা) হইতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেনঃ বদরের যুদ্ধের সময় উহাদিগকে সংখ্যায় কম দেখিয়াছি। শেষ পর্যন্ত আমি আমার পার্শ্বের এক লোককে বলিলাম, তুমি কি উহাদের সংখ্যা সত্তরজন দেখিয়াছ? এমনকি উহাদের এক লোককে বন্দী করিয়া উহাদের সংখ্যা জিজ্ঞেস করিলে সে উত্তর করিল আমাদের সংখ্যা এক হাজার।

আল্লাহ মিথ্যা বলেন
আল্লাহ 3

আবারে আসুন তাফসীরে জালালাইন থেকে পড়ি [3] –

৪৩. স্মরণ কর আল্লাহ তোমাকে নিদ্রায় স্বপ্নে তাদেরকে সংখ্যায় অল্প দেখয়েছিলেন। আর তদনুসারে তুমি তোমার সাহাবীদের এই সংবাদ প্রদান করলে তারা অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিল। আর তাদেরকে যদি অধিক করে তোমাকে দেখাইতেন তবে তোমরা হতবল হয়ে যেতে সাহস হারিয়ে ফেলতে এবং যুদ্ধ বিষয়ে বিরোধ করতে, বিবাদ করতে। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে সাহসহারা ও বিবাদ করা হতে রক্ষা করেছেন এবং বক্ষে যা আছে অর্থাৎ অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে তিনি সবিশেষ অবহিত ।

৪৩ ও ৪৪ তম আয়াতে প্রকৃতির এক অপূর্ব বিস্ময় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, যা বদর যুদ্ধের ময়দানে এই উদ্দেশ্যে কার্যকর করা হয়, যাতে উভয় বাহিনীর কোনো একটিও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে গিয়ে যুদ্ধের অনুষ্ঠানকেই না শেষ করে দেয়। কারণ, এ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে বস্তুগত দিক দিয়েও ইসলামের সত্যতার বিকাশ ঘটানো ছিল নির্ধারিত।
বস্তুত প্রকৃতির সে বিস্ময়টি ছিল এই যে, কাফের বাহিনী যদিও তিন গুণ বেশি ছিল, কিন্তু আল্লাহ তা’আলা শুধুমাত্র স্বীয় পরিপূর্ণ ক্ষমা ও কুদরতবলে তাদের সংখ্যাকে মুসলমানদের চোখে কম করে দেখিয়েছেন, যাতে মুসলমানদের মধ্যে কোনো দুর্বলতা ও বিরোধ সৃষ্টি হয়ে না যায়। আর এ ঘটনাটি ঘটে দু’বার। একবার মহানবীকে স্বপ্নযোগে দেখানো হয় এবং তিনি বিষয়টি মুসলমানদের কাছে বলেন। তাতে তাদের মনোবল বেড়ে যায়। আর দ্বিতীয়বার ঠিক যুদ্ধক্ষেত্রে যখন উভয় পক্ষ সামনা-সামনি হয়, তখন মুসলমানদেরকে কাফেরদের সংখ্যা কম করে দেখানো হয়। সুতরাং ৪৩ তম আয়াতে স্বপ্নের ঘটনা এবং ৪৪ তম আয়াতে প্রত্যক্ষ জাগ্রত অবস্থার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।

আল্লাহ 5
আল্লাহ 7
আল্লাহ 9

আল্লাহ কি প্রতারণা বা কৌশল করেন?

ইসলামের বিশ্বাস অনুসারে আল্লাহ পাক হচ্ছেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। চালাকি করা, ধূর্ততা বা প্রতারণার আশ্রয় নেয়া, এসব আমাদের মত সাধারণ মানুষের সাধারণ কাজ হতে পারে। কিন্তু সর্বশক্তিমান আল্লাহ পাক কেন এই ধরণের কাজ করতে যাবেন, তা এক অবাক করার মত বিষয়। যার কাছে সর্বময় ক্ষমতা, যিনি হুকুম দিলে মহাবিশ্ব গ্রহ নক্ষত্র নিমিষের মধ্যে সৃষ্টি হয়ে যায়, তিনি মানুষের কৌশল দেখে পাল্টাপাল্টি কৌশল করছেন, বিষয়টি আল্লাহর সর্বময় ক্ষমতার ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। যেন দুই পাড়ার দুই মাস্তানের যুদ্ধ, যেখানে দুইজনই একজন আরেকজনকে পরাজিত করতে প্রতারণা করছে!

সূরা আল-ইমরানের ৫৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সম্পর্কে الماكرين শব্দটি উল্লেখ করে বলা হয়েছে, আল্লাহ সবচেয়ে বড় প্রতারক বা ধূর্ত। আপনারা চাইলে এই শব্দটির অনুবাদ বিভিন্ন ডিকশনারিতে খুঁজে দেখুন, এটির অর্থ হচ্ছে প্রতারক বা ধূর্ততার সাথে যে কৌশল করে বা কুটকৌশলী। কিন্তু এই আয়াতটির বাঙলা অনুবাদে ইচ্ছাকৃতভাবে আল্লাহকে মোলায়েম করে কৌশলী বলা হয়েছে [4] –

আরবীঃ ومكروا ومكر الله والله خير الماكرين
এবং তারা কৌশল করেছিল এবং আল্লাহ্ও (জবাবে) কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ।
— Taisirul Quran

আর তারা (কাফিরেরা) ষড়যন্ত্র করেছিল ও আল্লাহও কৌশল করলেন এবং আল্লাহ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী।
— Sheikh Mujibur Rahman

আর তারা কুটকৌশল করেছে এবং আল্লাহ কৌশল করেছেন। আর আল্লাহ উত্তম কৌশলকারী।
— Rawai Al-bayan

আর তারা কুটকৌশল করেছিল, আল্লাহ্‌ও কৌশল করেছিলেন; আর আল্লাহ্‌ শ্রেষ্ঠতম কৌশলী [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

And they [i.e., the disbelievers] planned, but Allah planned. And Allah is the best of planners.
— Saheeh International
কোরআনঃ সূরা আল-ইমরান আয়াত ৫৪ )

এবারে আসুন আরো কয়েকটি আয়াত পড়ি [5] [6] [7] –

স্মরণ কর, সেই সময়ের কথা যখন কাফিরগণ তোমাকে বন্দী করার কিংবা হত্যা করার কিংবা দেশ থেকে বের করে দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করে। তারা চক্রান্ত করে আর আল্লাহও কৌশল করেন। আল্লাহই হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী।
— Taisirul Quran

আর স্মরণ কর, যখন কাফিরেরা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, তোমাকে বন্দী করবে অথবা হত্যা করবে কিংবা নির্বাসিত করবে। তারাও ষড়যন্ত্র করতে থাকুক এবং আল্লাহও (স্বীয় নাবীকে বাঁচানোর) কৌশল করতে থাকেন, আল্লাহ হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ কৌশলী।
— Sheikh Mujibur Rahman

আর যখন কাফিররা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল, তোমাকে বন্দী করতে অথবা তোমাকে হত্যা করতে কিংবা তোমাকে বের করে দিতে। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে উত্তম।
— Rawai Al-bayan

আর স্মরণ করুন, যখন কাফেররা আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে আপনাকে বন্দী করার জন্য, বা হত্য করার অথবা নির্বাসিত করার জন্য। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও (তাদের ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে) ষড়যন্ত্র করেন; আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রেষ্ঠ কৌশলী [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

And [remember, O Muḥammad], when those who disbelieved plotted against you to restrain you or kill you or evict you [from Makkah]. But they plan, and Allah plans. And Allah is the best of planners.
— Saheeh International
কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৩০ )

তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকে নির্ভয় হয়ে গেছে? নিশ্চিত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর কৌশল হতে কেউ নির্ভয় হতে পারে না।
— Taisirul Quran

তারা কি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে ? সর্বনাশগ্রস্থ সম্প্রদায় ছাড়া আল্লাহর পাকড়াও থেকে কেহই নি:শঙ্ক হতে পারেনা।
— Sheikh Mujibur Rahman

তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকে নিরাপদ হয়ে গিয়েছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত কওম ছাড়া আল্লাহর কৌশল থেকে আর কেউ (নিজদেরকে) নিরাপদ মনে করে না
— Rawai Al-bayan

তারা কি আল্লাহর কৌশল থেকেও নিরাপদ হয়ে গেছে? বস্তুত ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায় ছাড়া কেউই আল্লাহর কৌশলকে নিরাপদ মনে করে না [১]।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

Then, did they feel secure from the plan of Allah? But no one feels secure from the plan of Allah except the losing people.
— Saheeh International
কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৯৯ )

দুঃখ কষ্ট মানুষকে স্পর্শ করার পর আমি যখন তাদেরকে অনুগ্রহ আস্বাদন করতে দেই, তখন তারা আমার নিদর্শনগুলোর ব্যাপারে কুট কৌশলের আশ্রয় নেয়। বল, ‘কৌশল গ্রহণে আল্লাহ হলেন ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন, তোমরা যে সব কূটচাল গ্রহণ কর আমার ফেরেশতাগণ তা লিপিবদ্ধ করে রাখে।’
— Taisirul Quran

আর যখন আমি মানুষকে কোন নি‘আমাতের স্বাদ উপভোগ করাই তাদের উপর কোন বিপদ পতিত হওয়ার পর, তখনই তারা আমার আয়াতসমূহ সম্বন্ধে দুরভিসন্ধি করতে থাকে। তুমি বলে দাওঃ আল্লাহ অতি দ্রুত কলাকৌশল তৈরী করতে পারেন। নিশ্চয়ই আমার মালাইকা/ফেরেশতাগণ তোমাদের সকল দুরভিসন্ধি লিপিবদ্ধ করছে।
— Sheikh Mujibur Rahman

আর যখন আমি মানুষকে দুঃখ-দুর্দশা স্পর্শ করার পর রহমতের স্বাদ আস্বাদন করাই, তখন তারা আমার আয়াতসমূহের ব্যাপারে কূট-কৌশলের আশ্রয় নেয়। বল, ‘আল্লাহ কৌশলকারী হিসেবে অধিক দ্রুত’। নিশ্চয় আমার ফেরেশতারা তোমাদের কুট-কৌশল লিখে রাখে।
— Rawai Al-bayan

আর দুঃখ দৈন্য তাদেরকে স্পর্শ করার পর যখন আমরা মানুষকে অনুগ্রহের আস্বাদন করাই তারা তখনই আমাদের আয়াতসমূহের বিরুদ্ধে অপকৌশল করে [১]। বলুন, ‘আল্লাহ্‌ কৌশল অবলম্বনে আরো বেশি দ্রুততর [২]।‘ নিশ্চয় তোমরা যে অপকৌশল কর তা আমাদের ফিরিশতারা লিখে রাখে।
— Dr. Abu Bakr Muhammad Zakaria

And when We give the people a taste of mercy after adversity has touched them, at once they conspire against Our verses. Say, “Allah is swifter in strategy.” Indeed, Our messengers [i.e., angels] record that which you conspire.
— Saheeh International
কোরআনঃ সূরা ইউনুস আয়াত ২১ )

প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ ও মিথ্যা বলার অনুমতি

নবী মুহাম্মদ বলেছেন, যুদ্ধ হচ্ছে ধোঁকার জায়গা। প্রতিপক্ষকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য মিথ্যা বলা এবং প্রতারণা করাকে ইসলামে বৈধতা দেয়া হয়েছে [8]

সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত)
২১/ জিহাদ
পরিচ্ছেদঃ ৫. যুদ্ধে মিথ্যা ও ধোকার আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি আছে
১৬৭৫। আমর ইবনু দীনার (রাহঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যুদ্ধ হল ধোঁকা।

সহীহ, ইবনু মা-জাহ (২৮৩৩, ২৮৩৪)
আবূ ঈসা বলেন, আলী, জাইদ ইবনু সাবিত, আইশা, ইবনু আব্বাস, আবূ হুরাইরা, আসমা বিনতু ইয়াযীদ, কাব ইবনু মালিক ও আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতেও এ অনুচ্ছদে হাদিস বর্ণিত আছে। এ হাদিসটি হাসান সহিহ।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আমর ইবনু দীনার (রহঃ)

ছোটবেলা থেকে আমরা জেনে এসেছি, নবী মুহাম্মদ ছিলেন সত্যবাদী নবী। ছোটবেলায় নাকি তাকে এই কারণে আল আমিন বলে ডাকা হতো। প্রতিশ্রুতি রক্ষা এবং গচ্ছিত মাল সংরক্ষণ করায় তিনি নাকি ছিলেন কাফেরদের কাছেও বিশ্বাসযোগ্য। অথচ, হাদিসে পাওয়া যায়, তিনি তার অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কৌশল বলে দিচ্ছেন। বিষয়টি অবাক করার মত। তাহলে এতদিন ধরে যা শুনতাম, সবই কী মিথ্যা? হযরত মুহাম্মদ প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার খুব সুন্দর একটি কৌশল বলে দিয়েছেন, যার একদম সরাসরি প্রমাণ পাওয়া যায় বুখারী মুসলিম সহ অনেক হাদিসেই। নিচের হাদিস দুইটি পড়ুন, এখানে বলা হচ্ছে, কোন বিষয়ে কেউ যদি প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু পরে যদি তার বিপরীতটি তার কাছে উত্তম মনে হয়, তাহলে প্রতিশ্রুতির কাফফারা দিয়ে বিপরীত কাজটিই করা যাবে। এতো সরাসরি মিথ্যাচার, এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। কাফফারা দিলেই কি সব মাফ হয়ে যায়? [9] [10]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
৯৩/ আহ্‌কাম
পরিচ্ছেদঃ ৯৩/৬. যে ব্যক্তি নেতৃত্ব চায়, তা তার উপরই ন্যস্ত করা হয়।
৭১৪৭. ‘আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেনঃ হে ‘আবদুর রহমান ইবনু সামুরাহ! নেতৃত্ব চেয়ে নিও না। কেননা, যদি চাওয়ার পর তোমাকে তা দেয়া হয়, তাহলে তার সকল দায়িত্বভার তোমার উপরই অর্পিত হবে। আর যদি না চাওয়া সত্ত্বেও তোমাকে তা দেয়া হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) সহযোগিতা করা হবে। আর কোন বিষয়ে কসম করার পর তার বিপরীত দিকটিকে যদি উত্তম বলে মনে কর, তাহলে উত্তম কাজটিই করবে আর তোমার কসমের কাফ্‌ফারা আদায় করে দিবে। (৬৬২২) (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৬৪৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৬৬২)
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আব্দুর রহমান ইবন সামুরা (রাঃ)

সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন)
২৮/ কসম
পরিচ্ছেদঃ ৩. যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম করে, পরে এর বিপরীত বিষয়কে তার চেয়ে উত্তম মনে করে তবে তার জন্য উত্তমটিই করা এবং কসমের কাফফারা দেওয়া মুস্তাহাব

৪১২৬। আবূ তাহির (রহঃ) … আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি কোন বিষয়ে কসম করে, পরে তার বিপরীতটিকে তার চেয়ে উত্তম মনে করে, তবে সে যেন তার কসমের কাফফারা দেয় এবং (ঐ কাজটি) করে ফেলে।
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)

অনেকগুলো হাদিস থেকে জানা যায়, রাতের অন্ধকারে খুনী পাঠিয়ে মানুষ হত্যা করাতেন নবী। এই হত্যা করতে পাঠাবার সময় তিনি তার সাহাবীদের মিথ্যা বলার অনুমতিও দিতেন। শুধু যুদ্ধ ক্ষেত্রেই নয়, যুদ্ধের বাইরেও তিনি লোক পাঠিয়ে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মানুষ খুন করাতেন। [11]

সহীহ বুখারী (তাওহীদ)
অধ্যায়ঃ ৬৪/ মাগাযী (যুদ্ধ)
পরিচ্ছদঃ ৬৪/১৫. কা‘ব ইব্নু আশরাফ-এর হত্যা
(কা‘ব ইবনু আশরাফ বনী কুরায়যা গোত্রের একজন কবি ও নেতা ছিল যে বিভিন্ন সময় রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর নামে বিদ্রুপাত্মক কথা প্রচার করতো। এমনকি সম্ভ্রান্ত মুসলিমদের স্ত্রী কন্যাদের সম্পর্কেও কুৎসিত অশালীন উদ্ভট কথা রচনা করতো। এসকল কর্মকাণ্ডে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে অবশেষে তৃতীয় হিজরী সনের রবীউল আওয়াল মাসে রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মুহামমাদ ইবনু মাসলামাহকে নির্দেশ দেন তাকে যেন হত্যা করা হয়। এবং সে আদেশ মতে তাকে হত্যা করা হয়।)

৪০৩৭. জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, কা‘ব ইবনু আশরাফের হত্যা করার জন্য কে প্রস্তুত আছ? কেননা সে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দিয়েছে। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) দাঁড়ালেন, এবং বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি চান যে, আমি তাকে হত্যা করি? তিনি বললেন, হাঁ। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, তাহলে আমাকে কিছু প্রতারণাময় কথা বলার অনুমতি দিন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হাঁ বল। এরপর মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) কা‘ব ইবনু আশরাফের নিকট গিয়ে বললেন, এ লোকটি (রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সদাকাহ চায় এবং সে আমাদেরকে বহু কষ্টে ফেলেছে। তাই আমি আপনার নিকট কিছু ঋণের জন্য এসেছি। কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল, আল্লাহর কসম পরে সে তোমাদেরকে আরো বিরক্ত করবে এবং আরো অতিষ্ঠ করে তুলবে। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আমরা তাঁর অনুসরণ করছি। পরিণাম কী দাঁড়ায় তা না দেখে এখনই তাঁর সঙ্গ ত্যাগ করা ভাল মনে করছি না। এখন আমি আপনার কাছে এক ওসাক বা দুই ওসাক খাদ্য ধার চাই।

বর্ণনাকারী সুফ্ইয়ান বলেন, ‘আমর (রহ.) আমার নিকট হাদীসটি কয়েকবার বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তিনি এক ওসাক বা দুই ওসাকের কথা উল্লেখ করেননি। আমি তাকে বললাম, এ হাদীসে তো এক ওসাক বা দুই ওসাকের কথাটি বর্ণিত আছে, তিনি বললেন, মনে হয় হাদীসে এক ওসাক বা দুই ওসাকের কথাটি বর্ণিত আছে। কা‘ব ইবনু আশরাফ বলল, ধার তো পাবে তবে কিছু বন্ধক রাখ। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, কী জিনিস আপনি বন্ধক চান। সে বলল, তোমাদের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রাখ। মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আপনি আরবের একজন সুশ্রী ব্যক্তি, আপনার নিকট কীভাবে, আমাদের স্ত্রীদেরকে বন্ধক রাখব? তখন সে বলল, তাহলে তোমাদের ছেলে সন্তানদেরকে বন্ধক রাখ। তিনি বললেন, আমাদের পুত্র সন্তানদেরকে আপনার নিকট কী করে বন্ধক রাখি? তাদেরকে এ বলে সমালোচনা করা হবে যে, মাত্র এক ওসাক বা দুই ওসাকের বিনিময়ে বন্ধক রাখা হয়েছে। এটা তো আমাদের জন্য খুব লজ্জাজনক বিষয়। তবে আমরা আপনার নিকট অস্ত্রশস্ত্র বন্ধক রাখতে পারি। রাবী সুফ্ইয়ান বলেন, লামা শব্দের মানে হচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র। শেষে তিনি (মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ) তার কাছে আবার যাওয়ার ওয়াদা করে চলে আসলেন। এরপর তিনি কা’ব ইবনু আশরাফের দুধ ভাই আবূ নাইলাকে সঙ্গে করে রাতের বেলা তার নিকট গেলেন। কা’ব তাদেরকে দূর্গের মধ্যে ডেকে নিল এবং সে নিজে উপর তলা থেকে নিচে নেমে আসার জন্য প্রস্তুত হল। তখন তার স্ত্রী বলল, এ সময় তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল, এই তো মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ এবং আমার ভাই আবূ নাইলা এসেছে। ‘আমর ব্যতীত বর্ণনাকারীগণ বলেন যে, কা’বের স্ত্রী বলল, আমি তো এমনই একটি ডাক শুনতে পাচ্ছি যার থেকে রক্তের ফোঁটা ঝরছে বলে আমার মনে হচ্ছে। কা’ব ইবনু আশরাফ বলল, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ এবং দুধ ভাই আবূ নাইলা, (অপরিচিত কোন লোক তো নয়) ভদ্র মানুষকে রাতের বেলা বর্শা বিদ্ধ করার জন্য ডাকলে তার যাওয়া উচিত। (বর্ণনাকারী বলেন) মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) সঙ্গে আরো দুই ব্যক্তিকে নিয়ে সেখানে গেলেন। সুফ্ইয়ানকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, ‘আমর কি তাদের দু’জনের নাম উল্লেখ করেছিলেন?

উত্তরে সুফ্ইয়ান বললেন, একজনের নাম উল্লেখ করেছিলেন। ‘আমর বর্ণনা করেন যে, তিনি আরো দু’জন মানুষ সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন, যখন সে (কা’ব ইবনু আশরাফ) আসবে। ‘আমর ব্যতীত অন্যান্য রাবীগণ (মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামার সাথীদের সম্পর্কে) বলেছেন যে (তারা হলেন) আবূ আবস্ ইবনু জাব্র হারিস ইবনু আওস এবং আববাদ ইবনু বিশ্র। ‘আমর বলেছেন, তিনি অপর দুই লোককে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাদেরকে বলেছিলেন, যখন সে আসবে তখন আমি তার মাথার চুল ধরে শুঁকতে থাকব। যখন তোমরা আমাকে দেখবে যে, খুব শক্তভাবে আমি তার মাথা আঁকড়িয়ে ধরেছি, তখন তোমরা তরবারি দ্বারা তাকে আঘাত করবে। তিনি (মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ) একবার বলেছিলেন যে, আমি তোমাদেরকেও শুঁকাব। সে (কা‘ব) চাদর নিয়ে নিচে নেমে আসলে তার শরীর থেকে সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল। তখন মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আজকের মত এতো উত্তম সুগন্ধি আমি আর কখনো দেখিনি। ‘আমর ব্যতীত অন্যান্য রাবীগণ বর্ণনা করেছেন যে, কা‘ব বলল, আমার নিকট আরবের সম্ভ্রান্ত ও মর্যাদাসম্পন্ন সুগন্ধী ব্যবহারকারী মহিলা আছে।

‘আমর বলেন, মুহাম্মাদ ইবনু মাসলামাহ (রাঃ) বললেন, আমাকে আপনার মাথা শুঁকতে অনুমতি দেবেন কি? সে বলল, হাঁ। এরপর তিনি তার মাথা শুঁকলেন এবং এরপর তার সাথীদেরকে শুঁকালেন। তারপর তিনি আবার বললেন, আমাকে আবার শুকবার অনুমতি দেবেন কি? সে বলল, হাঁ। এরপর তিনি তাকে কাবু করে ধরে সাথীদেরকে বললেন, তোমরা তাকে হত্যা কর। তাঁরা তাকে হত্যা করলেন। এরপর নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে এ খবর দিলেন। (২৫১০; মুসলিম ৩২/৪৩, হাঃ ১৮০১) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৩৭৩৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৩৭৩৯)
হাদিসটির আর্কাইভ লিংক
হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)

উপসংহার

উপরের আলোচনা থেকে এটি খুবই স্পষ্ট যে, আল্লাহ পাক যুদ্ধে জয়ী হওয়ার ইচ্ছায় মিথ্যা বলেছেন। ইসলামকে তিনি বিজয়ী করার জন্য মিথ্যা বলেন। তার রাজত্ব কায়েমের জন্য তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেন। তিনি প্রতিপক্ষকে হারাবার জন্য প্রতিপক্ষের মতই কৌশল বা প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। একই সাথে নবী মুহাম্মদের চরিত্রও একদম এক। তিনিও যুদ্ধে ধোঁকাবাজী বা ধাপ্পাবাজীর অনুমতি দেন, এমনকি যুদ্ধের বাইরেও প্রতারণামূলকভাবে কাউকে খুন করাবার অনুমতি দেন। সেই সাথে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের কৌশলও বলে দেন। কিন্তু আল্লাহর মত সর্বশক্তিমানের জন্য সামান্য বিষয়ে মিথ্যা বলার বিষয়টি মেনে নেয়া কষ্টকর। এর থেকে বোঝা যায়, নবী মুহাম্মদই বানিয়ে এসকল আয়াত নাজিল করতেন, এবং তার সাহাবীদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য বানিয়ে বানিয়ে অনেক ভবিষ্যতবানী। সেগুলোর মধ্যে কিছু পরবর্তীতে সত্য হলে তিনি বড়াই করে বলতেন, দেখেছো, আল্লাহ কখনো মিথ্যা বলে না। আবার কিছু কথা যখন ভুল হতো, কিছু ভবিষ্যতবানী যখন মিথ্যা প্রমাণিত হতো, তিনি আরেকটি আয়াত নামিয়ে ফেলতেন এই বলে যে, আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য কিংবা মনোবল বৃদ্ধির জন্য ইচ্ছে করে মিথ্যা বলেছেন। মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ কিছু তুচ্ছ কাফেরের সাথে মারামারিতে জেতার জন্য মিথ্যা বলবেন, এরকম হাস্যকর কথা একমাত্র নির্বোধ মানুষই বিশ্বাস করবে। এগুলো সবই যে আসলে নবীর ধূর্ত মাথার চালাকি, এই বিষয়গুলো এখান থেকে খুব পরিষ্কারভাবেই ফুটে ওঠে।

তথ্যসূত্রঃ

  1. কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৪৩ []
  2. তাফসীরে ইবনে কাছীর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, চতুর্থ খণ্ড পৃষ্ঠা ৪৬৭, ৪৬৮ []
  3. তাফসীরে জালালাইন, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৫৭৬, ৫৭৯, ৫৮০ []
  4. কোরআনঃ সূরা আল-ইমরান আয়াত ৫৪ []
  5. কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৩০ []
  6. কোরআনঃ সূরা আনফাল আয়াত ৯৯ []
  7. কোরআনঃ সূরা ইউনুস আয়াত ২১ []
  8. সূনান আত তিরমিজী (তাহকীককৃত), হাদিস নম্বরঃ ১৬৭৫ []
  9. সহীহ বুখারী (তাওহীদ), হাদিস নম্বরঃ ৭১৪৭ []
  10. সহীহ মুসলিম (ইসলামিক ফাউন্ডেশন), হাদিস নম্বরঃ ৪১২৬ []
  11. সহীহ বুখারী (তাওহীদ), হাদিস নম্বরঃ ৪০৩৭ []

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *