ইসলাম ধর্ম

মুহাম্মদের সংস্কৃতি ঘৃণা আর মুমিনের মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘৃণা

এমডি মাহাদী হাসান: সারাদিন পহেলা বৈশাখ নিয়ে অনেক পোস্ট দেখলাম। কিন্তু কাজের কথা কারো কাছ থেকে পেলাম না। তাই আসল ঘটনা বের করতে নিজেই লিখলাম। মুমিনরা মঙ্গল শোভাযাত্রা কে ঘৃণা করে মুহাম্মদের শিক্ষার কারণে। মুহাম্মদ শিল্প কে ঘৃণা করতো, সাহিত্য কে ঘৃণা করতো, সংস্কৃতি কে ঘৃণা করতো। আর এরই অংশ হিসেবে মুহাম্মদের চ্যলারা আজ বাংলাদেশের বৈশাখী উৎসবের মঙ্গল শোভাযাত্রা কে ঘৃণা করে ও বন্ধ করতে চায়। প্রথমে আসি মঙ্গল শোভাযাত্রাতে বিভিন্ন ছবি ও মূর্তি তৈরি নিয়ে। মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়জন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের উদ্যোগে। আর চারুকলা মানেই শিল্প, আর্ট এবং শৈল্পিকতা। চারুকলা অনুষদের ছাত্রছাত্রীরা বিভিন্ন ভাবে তাদের শৈল্পিকতা দিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি, প্রতিকৃতি, মুখোশ ইত্যাদি তৈরি করে। এবং পহেলা বৈশাখের দিন তারা তাদের তৈরি শিল্প গুলো প্রদর্শনের জন্য বের করে। এখন মুমিনদের হেড়ে মাথায় আছে যে হিন্দুরা মূর্তি বানায়, ছবি বানায় আর পূজা করে। এরাও ছবি বানাচ্ছে, মূর্তি বানাচ্ছে তাইলে এরাও হিন্দু এবং এরা বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদ প্রচার করতে চাই। কিন্তু এটার সাথে হিন্দু ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই এবং এটা শুধুই মানুষের শৈল্পিক জ্ঞানের প্রকাশ। এখন মুমিনরা এটা যদি বন্ধ করতে চাই তাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বাংলাদেশের সকল চারুকলা বিভাগ বন্ধ করতে হবে। কারণ চারুকলা প্রতিষ্ঠান গুলোতে সকল সময়ই ছবি, প্রতিকৃতি তৈরি, নাচ, গান সহ সকল সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চলে যার সবই ইসলামে হারাম। মঙ্গল শোভাযাত্রা কিছুই না। এদিন শুধু এগুলো রাস্তায় বের করা হয়। কিন্তু এগুলো তৈরি এবং এর চর্চা তো সারা বছরই হয়। তাই এগুলো নিষিদ্ধ হলে বাংলাদেশের সকল চারুকলা ও শিল্পকলাই বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ (মুমিন মতে)।

এবার মুহাম্মদের ছবি নিয়ে চুলকানিটা একটু দেখা যাক।

একাধিক সহী হাদিস এবং ইসলামিক নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকে জানা যায় যে ইসলামে ছবি আঁকা, ছবি তৈরি করা, মূর্তি তৈরি করা ইত্যাদি নিষিদ্ধ ও হারাম । মুহাম্মদ বলেছেন কেয়ামতের দিন যারা এগুলো করে তাদের আল্লাহ বলবেন “তোমারা যা তৈরি করেছো সেগুলিকে প্রাণ দাও” এবং তারা যখন তা করতে পারবে না তখন তাদের কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে । কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো কেনো ? ছবিতে সমস্যা কোথায় ? আমরা জানি আল্লাহ কোরআন লিখিত ভাবে অক্ষরের মাধ্যমে মানুষের কাছে পাঠিয়েছেন । কিন্তু… আল্লা কি জানেননা এই লেখা কিভাবে এসেছে ? লেখার জন্মই হয়েছে ছবির মাধ্যমে । মানবজাতি প্রথম মনের ভাব চিহ্নে আদান প্রদান শুরু করে ছবির মাধ্যমে । মানুষ প্রথম কলম জাতীয় জিনিষ হাতে নিয়েছিলো ছবি আকার জন্য । বহু উদাহরণের মধ্যে যেমন প্রাচীন মিশরিয় লেখালেখির ইতিহাস ধরা যাক যেটা শুরু হয়েছে ছবির মাধ্যমে । তারা পাখি, সাপ, মানুষ ইত্যাদির ছবি আকার মাধ্যমে লিখিত মনের ভাব আদান প্রদান করতো । প্রাচীন কালে বিভিন্ন পশু, পাখি, সাপ, মানুষ, জীব-জানোয়ার ও বস্তুর ছবিই ছিলো অক্ষর, শব্দ ও সাংকেতিক চিহ্ন । আর এই ছবি গুলোই কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হতে হতে আজকে আমরা যে সকল অক্ষর ব্যাবহার করি লেখালেখির জন্য সেগুলোতে পরিণত হয়েছে । তো… যে লেখার মাধ্যমে আল্লাহ তার বানী পাঠিয়েছেন সেই লেখার জন্মতেই যখন ছবি আঁকা জড়িত তাহলে এই ছবি হারাম করার মানে কি ?
শুধু তাই নয় মানব জাতির সাথে ছবি আকার সম্পর্ক আরো সুগভীর । সুপ্রাচীন যুগে যখন মানুষ জঙ্গলে ও গুহায় বসবাস করতো সেই সময়ের মানুষের ব্যবহৃত বহু পরিত্যক্ত গুহা আফ্রিকা সহ পৃথিবীর বহু প্রান্তে খুঁজে পাওয়া যায় । এই সকল গুহার ভিতরে পাথরে খোদায় করা বা দাগ দেওয়া সেই আদি মানুষদের হাতে আঁকা ছবি পাওয়া যায় । এগুলো কে বলে “কেইভ পেইন্টিং” বা “গুহা ছবি” । সেখানে বিভিন্ন রকমের ছবি পাওয়া যায় যেমন মানুষরা শিকার করছে, আগুনের পাশে বসে আছে ইত্যাদি ইত্যাদি । তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সৃতি গুলো গুহার দেওয়ালে ছবির মাধ্যমে রেখে গেছেন । এই ছবিগুলো ছাড়া আমরা আজ আমাদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে বসবাস করতো, কিভাবে জীবন যাপন করতো সেগুলো সম্পর্কে হয়তো কিছুই জানতাম না । এবং এই ছবিগুলোই প্রমাণ করে যে মনুষ্য সভ্যতা বিকাশের সেই আদিকাল থেকেই মানুষ ছবি আঁকছে । ছবি আঁকা মনুষ্য সভ্যতা বিকাশের সৃষ্টি লগ্ন থেকেই মানুষের সাথে জড়িয়ে আছে । কারণ ছবি হলো সর্বজনীন ভাষা । ছবির ভাষা সকলেই বোঝে । অশিক্ষিত অথবা লেখাপড়া জানা… একটি ছবি কি বলছে তা সকলেই বোঝে ।

ছবি আঁকা মানুষের সহজাত একটি প্রতিভা । আমি একদিন বিছানায় কাজ করার সময়য় হঠাৎ দেখি আমার শিশু ভাগ্নিটি আমার পড়ার টেবিল থেকে খাতা কলম নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলো । সে বিভিন্ন দাগ দিয়ে মানুষের অবয়ব বানাচ্ছিলো । এগুলো তাকে কেউ শেখায়নি । সে নিজে থেকেই ছবি আঁকছিল । মানব শিশুরা দুই আড়াই বছর বয়স থেকেই নিজে নিজে ছবি আঁকতে পারে । উন্নত দেশ গুলোতে শিশুদের স্কুলে তাদের দৈনন্দিন ছবি আঁকতে দেওয়া হয় । কারণ গবেষণায় দেখা গেছে ছবি আঁকা শিশুদের মস্তিষ্ক বিকাশে অসামান্য অবদান রাখে । ছবি আঁকা শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটায়, তাদের চিন্তাশক্তি এবং সৃজনশীল শক্তি বৃদ্ধি করে । প্রতিবন্ধী শিশুদের ক্ষেত্রে ছবি আকা তাদের মস্তিষ্ক বিকাশে ভূমিকা রাখে । যে সকল শিশুরা মনের ভাব সহজে প্রকাশ করতে পারে না তাদের ক্ষেত্রে অনেক সময়য় দেখা যায় তারা ছবি আকার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে ।
ছবি আঁকা মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য । ছবি আঁকা মানুষের শৈল্পিক মনের বিকাশ । ছবি আঁকা না থাকলে আমরা পিকাসো, মাইকেল এঞ্জেলো, ভিনসেন্ট ভান এর মতো অসামান্য শিল্পীদের পেতাম না যাদের রঙ তুলি ছিলো মানুষের শৈল্পিক সৃষ্টিশীলতার উদাহরণ । ছবি আঁকা না থাকলে আমরা লিওনার্দো ভিঞ্চির মতো জিনিয়াস শিল্পী পেতাম না যার ছবি এবং ছবিতে থাকা রহস্য সমগ্র বিশ্ব কে আজো অভিভূত করে রেখেছে । ছবি আকার মাধ্যমেই বোঝা যায় মানুষের কতো শৈল্পিক গুন সম্পন্ন । কি অসামান্য সৌন্দর্য মানুষ শুধুমাত্র রঙ তুলিতে গড়ে তুলতে পারে ।

ছবি শুধু রঙ তুলিতেই সীমাবদ্ধ নয় । আজ ছবির ডিজিটালাইজেশন হয়েছে । ছবির ডিজিটালাইজেশনের কারণে আমরা এক স্থানের ছবি অন্য স্থানে দেখতে পারছি । টেলিভিশন বা অন্যান্য মিডিয়া ছবি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না । সিসি টিভি ও এই ধরণের প্রযুক্তি গুলো যেগুলো সুরক্ষার জন্য ব্যাবহার করা হয় তাতে ছবির কোন বিকল্প নেই । মজার কথা হলো, মুসলিমরা যদি প্রযুক্তি প্রস্তুত করতো তাহলে আমরা হয়তো কোনদিনো মাল্টিমিডিয়া প্রযুক্তির মুখ দেখতাম না । একবার চিন্তা করুন তো… ছবি ছাড়া কি আমাদের বর্তমান পৃথিবী সম্ভব ? কিন্তু মুহাম্মদ ছবি কে ঘৃণা করে আর তার সেই ঘৃণার ফল আমরা তার চ্যলাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা ঘৃণার মাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি। মুমিনরা যদি পারে তাইলে বাংলাদেশে সংস্কৃতি চর্চাই বন্ধ করে দেবে। অথচ শিল্প সংস্কৃতি মানুষের যোগ্যতার অন্যতম একটি নিদর্শন। মানুষ শিল্পের মাধ্যমে কি অদ্ভুত সৌন্দর্য সৃষ্টি করতে পারে তার নমুনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *